আড়াই মাসের মাথায় আবারও একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে; খালে পড়ে তলিয়ে গেছে ১১ বছর বয়সী এক শিশু।
কামাল উদ্দিন নামের শিশুটি সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর ভূমি অফিস সংলগ্ন চশমা খালে পড়ে যায়। মঙ্গলবার বিকেলে সেই খবর পাওয়া পর সেখানে তল্লাশি শুরু করে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিসের বায়েজিদ বোস্তামি স্টেশনের লিডার বিপ্লব চন্দ্র মালাকার বলেন, “এখনো ডুবুরিরা চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত আবর্জনার কারণে উদ্ধার কাজ ব্যহত হচ্ছে।
“স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে জানানো হয়েছে। আবর্জনা সরাতে সিটি করপোরেশন থেকে একটি এক্সক্যাভেটর দিতে বলেছি, যাতে ময়লা সরানো যায়।”
তলিয়ে যাওয়া কামাল ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকার আলী কাওসারের ছেলে। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে কামাল সবার ছোট।
কামালের সাথে মো. রাকিব নামে আরেকটি শিশুও সোমবার খালে পড়ে যায়। পরে সে উঠে আসতে সক্ষম হয়।
চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর ভূমি অফিস সংলগ্ন চশমা খালে পড়ে সোমবার কামাল উদ্দিন নামের একটি শিশু নিখোঁজ হয়। মঙ্গলবার বিকালে সেই খবর পেয়ে তল্লাশি শুরু করে ফায়ার সার্ভিস।
বাবুফায়ার সার্ভিসের কর্মী বিপ্লব বলেন, “সোমবার কামাল ও রাকিব খালে নেমে ময়লার স্তূপের মধ্যে থেকে কিছু একটা তুলতে চেয়েছিল। পরে তারা হঠাৎ করে আবর্জনার ভেতর ডুবে যায়। স্রোত তাদের টেনে নেয়। কিছু দূর গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে রাকিব উঠে আসে। কিন্তু কামাল স্রোতের টানে চলে যায়।”
কামালের বাবা আলী কাওসার সোমবার ওই এলাকায় গিয়ে নিজেই সন্তানের খোঁজ করেন। পরে মঙ্গলবার ফায়ার সার্ভিস খবর পেয়ে উদ্ধার অভিযানে যায়।
চলতি বছরের ভারি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার মধ্যে ২৫ অগাস্ট মুরাদপুর এলাকায় চশমা খালে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামের এক সবজি ব্যবসায়ী। এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি।
তার আগে ৩০ জুন ষোলশহরের চশমা হিল এলাকাতেও এমন দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে একটি অটোরিকশা খালে পড়ে গেলে মারা যান চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)।
সবশেষ ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে আগ্রাবাদে নবী টাওয়ারের কাছাকাছি নাছিরছড়া খালে পড়ে তলিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদিয়া। পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় কয়েক টন আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে ১৯ বছর বয়সী সাদিয়ার লাশ উদ্ধার হয়।
১৮ সালের ৯ জুন নগরীর আমিন জুট মিল এলাকায় নালায় পড়ে মারা যায় আল আমীন নামে ৭ বছরের এক শিশু।
অপর দিকে এতা মৃত্যুর পরেও চট্টগ্রাম নগরজুড়ে নালা-খালগুলো এখনো মরণফাঁদ। অরক্ষিত ও বেড়া ছাড়া খালগুলোতে প্রায় সময় পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এসব খাল-নালায় রিকশা, অটোরিকশা পড়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এ নিয়ে চসিক কিংবা সিডিএ’র কোনো উদ্যোগ নেই। প্রতিকারে নেওয়া হয় না কার্যকর ব্যবস্থা। দুর্ঘটনার বিষয়গুলো আমলে নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিলে অন্তত প্রাণহানি রোধ করা যেত।
চসিকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, অধিকাংশ খালে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। এতে পা পিছলে বা অবহেলায় পড়ে যান পথচারী। মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে বড় উন্মুক্ত নালা, বহদ্দারহাট থেকে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত সড়কের পাশ, আগ্রাবাদ, জিইসি মোড়, দুই নম্বর গেটসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কের পাশে নিরাপত্তা দেওয়াল ছাড়া নালা-নর্দমা। বর্তমানে নগরীর ছোট-বড় খাল আছে ৫৭টি। এসব খালের দৈর্ঘ্য ১৬১ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৭ দশমিক ২৮ মিটার। পাকা ফুটপাত আছে ১৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১ দশমিক ৮০ মিটার গড় প্রস্থের মোট ১৩৮টি। প্রতিরোধ দেওয়ালের মোট দৈর্ঘ্য ২ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ১ দশমিক ২৫ মিটার। মোট কালভার্ট ১ হাজার ৫৪টি। মুরাদপুরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ওই জায়গায় এক সময় স্লাব দিয়ে ঢাকা ছিল। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের জন্য বছরখানেক আগে স্লাব সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর সেখানে নতুন করে আর কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ঘটে এ দুর্ঘটনা। ঘটনার দিন সেখানে কোনো রেলিং বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি সতর্কতামূলক কোনো সাইনবোর্ডও ছিল না। এতে পা পিছলে খালে পথচারী তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সিডিএ’র নগর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, বড় প্রকল্প কাজ চলাকালে কিছু নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রাখা উচিত। নিরাপত্তার দিকটি মাথায় রেখেই কাজ করতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে খাল সংস্কারসহ নানা কাজে নিরাপত্তার দিকগুলো মাথায় রেখে কাজ করা হচ্ছে না। এজন্য প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে। চসিক সূত্র জানায়, নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় দেড় শতাধিক ড্রেন রয়েছে। যার পুরোটাই অরক্ষিত। এছাড়া রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য খাল। এসব খালের পাশেও নেই কোনো সীমানা দেওয়াল।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, খাল-নালায় পড়ে একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছেন। অথচ তারা একে অন্যকে দোষারোপে ব্যস্ত রয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের ভূমিকা এখনও নির্বিকার। তাদের উচিত দ্রুত খাল-নালাগুলোয় নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
সরেজমিন দেখা গেছে, নগরের বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত চাক্তাই খালের দৈর্ঘ্য ছয় কিলোমিটার। চকবাজার ঘাসিয়াপাড়া এলাকায় খালটির পাশেই চলাচলের রাস্তা। গত বিকেলে সেই হাজি আরবান আলী সড়কে শিশুদের খেলাধুলা করতে দেখা গেছে।
মুরাদপুরে জলাবদ্ধতায় সড়ক-খাল একাকার হয়ে গেলে তাতে পড়ে নিখোঁজ হন সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ। এখনও তার খোঁজ মেলেনি। সেখানে চিকন দুটি রশি বেঁধে দিয়ে দায় সারলেও মুরাদপুর থেকে ২ নম্বর গেট পর্যন্ত পুরো খালটি এখনও খোলা। বিপরীতে মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্তও একই চিত্র।
নগরের বায়েজীদ বোস্তামি সড়ক থেকে ডান পাশে কয়েকশ মিটার গেলেই একটি কালভার্ট। তার নিচে বয়ে গেছে চশমা খাল। কালভার্ট পার হলেই বাঁদিকে খালের পাড় দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। গত ৩০ জুন এই রাস্তা থেকে পাশের চশমা খালে পড়ে যায় একটি সিএনজি অটোরিকশা। প্রচণ্ড স্রোতে ভেসে যান চালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগম। পরে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অনেক দিন পার হলেও খালের পাড়টি এখনও অনিরাপদ। কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। খালপাড়ের এম আর ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের কর্মচারী মো. সবুজ বলেন, 'ঘটনার পর অনেকে এখানে এসেছিল। এরপর এখানে আর কেউ আসেনি। কোনো ব্যবস্থাও নিতে দেখা যায়নি।'
২০১৫ সালে নগরের আগ্রাবাদ সিঅ্যান্ডবি কলোনির পাশে বিল্লাপাড়া নাছির খালে সিএনজি অটোরিকশা পড়ে নিহত হন ব্যবসায়ী ফিরোজ জামান খান ও চালক মাহবুবুর রহমান। ছয় বছর পেরোলেও একই স্থানে গিয়ে খালটির পাড়ে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী দেখা যায়নি।
নগরের বাদুড়তলার হারেশ শাহ মাজার লেন। উন্মুক্ত নালার পাশে সড়ক। নগরের বহদ্দারহাট থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নালা। এই নালার কোথাও কোনো স্ল্যাব নেই। নালার পাড়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রেতা চলাচলের জন্য কাঠ ও লোহার পাত দিয়ে নালার ওপর যাতায়াতের পথ তৈরি করেছে। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, বৃষ্টি হলে সড়ক আর নালাটি ভয়ংকর রূপ নেয়। প্রচণ্ড স্রোতের কারণে তখন তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়ারও ভরসা পান না।
উন্মুক্ত খাল-নালার পরিসংখ্যান নেই: নগরের খাল আছে ৫৭টি। খালগুলোর দৈর্ঘ্য ১৬৫ কিলোমিটার। নালা রয়েছে ৯৭২ কিলোমিটার। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় এর মধ্যে ৩৬টি খালের ৯৭ কিলোমিটার ও ৩০২ কিলোমিটার নালায় সংস্কারকাজ করছে সিডিএ। বাকি ২১ খালের ৬৮ কিলোমিটার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চসিকের। কিন্তু এসব খাল-নালার কী পরিমাণ উন্মুক্ত আছে, তার কোনো পরিসংখ্যানও নেই তাদের কাছে।