বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ৫০ বছরের হলেও চা শ্রমিকদের শ্রম-ঘামের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। তবুও আজ তারা নানা বৈষম্যের স্বীকার। নেই তাদের ভূমি অধিকার। মিলেনি চা শ্রমিক দিবসের জাতীয় স্বীকৃতি! অথচ সেই শিল্পে নিরলস ভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে দেশের মোট ১৬৩টি চা বাগানের লক্ষাধিক চা শ্রমিক। আর সেই চা বাগানের মধ্যে ৯৭টি বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে এসব চা বাগানে কর্মরত লক্ষাধিক চা শ্রমিক দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখলেও এখনও তাদেরকে বেতন বৈষম্যসহ নানা বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। প্রায় দুই‘শ বছর ধরে চা শ্রমকিদরে ঘামে শ্রমে প্রতি বছর চা উৎপাদনরে লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়ে গলেও তাদের ছেড়ে যায়নি দারিদ্রতা। প্রতিদিন ১২০ টাকার মুজড়ি (দৈনিক বেতন) দিয়ে পরিবার নিয়ে চালাতে হচ্ছে জীবন।
এদিকে দেশে ২য় বারের মতো পালিত হচ্ছে জাতীয় চা দিবস। আজ এ দিবস উপলক্ষে শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট দিনব্যাপী নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন চা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আব্দুল আজিজ।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি পংকজ কন্দ জানান, সারাদেশে কর্মরত চা শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ ভাগের উপরে নারী চা শ্রমিক রয়েছেন। আর এই চা জনগোষ্টির সংখ্যা সাত লাখ। তবে তাদের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার নিয়মিত চা শ্রমিক কাজ করেন এই জেলায় তাদের সিংহ ভাগ নারী।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে এসব চা বাগানে কর্মরত লক্ষাধিক চা শ্রমিক দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখনও তাদেরকে বেতন বৈষম্যসহ নানা বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। প্রতিদিন জীবনের ঝুকি নিয়ে বাগানে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশই নারী শ্রমিক। কিন্তু তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে শুরু করে জীবন যাত্রার কোন বদল আজও হয়নি। ভূমি অধিকার প্রদান এবং জীবন চলার উপযোগী করে বেতন বৃদ্ধি চা শ্রমিকদের প্রধান দাবি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, নারী-পুরুষের মজুরি এখন দৈনিক ১২০ টাকা হলেও তিন ক্যাটাগড়ির বাগান রয়েছে। ফলে অনেক বাগানে নারী শ্রমিকদের মজুরী নুন্যতম ৮৫ টাকাও দেয়া হচ্ছে। শ্রমিকদের মজুরি এক হওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়না। এদিকে কর্মক্ষেত্রে নারীদের বড় সমস্যা হলো নারীদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিভিন্ন বাঁধার মুখে পড়তে হয়। একেকটি সেকশনে (পৃথক পৃথক আবাদ) বৃষ্টির সময় ছাউনি থাকে না। ফলে বৃষ্টি গায়ে মেখেই কাজ করাতে গিয়ে ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগশোকে ভূগতে হয়। তারা যেটা চান সেটা হচ্ছে তাদের সপ্তাহের মজুরী বৃদ্ধি। এখন তারা যে টাকা পান সেটি দিয়ে না ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন, না নিজেরা ভালো কিছু খেতে পারেন।
এদিকে, নারী শ্রমিকসহ সকল চা শ্রমিকদের পরিবার ও তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের বিষয় ও চা শ্রমিকদের অধিকার এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করলেও তেমন কোন সুফল হয়না বলে জানান চা শ্রমিক নেতারা।
চা শ্রমিক নেতা পরিমল সিং বারাইক বলেন, মজুরি ১২০ টাকা আর কিছু রেশন। এই দিয়েই মা বাবা, স্বামী সন্তান নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন চা শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের গল্প এখনকার এই আধুনিক যুগেও কল্পকথার মতোই মনে হবে, যদি না কাছে এসে তাদের কেউ না দেখে।
শ্রীমঙ্গল রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চা শ্রমিক নেতা বিজয় বুনার্জী বলেন, বর্তমানে চা বাগানে বেড়েছে জনসংখ্যা। প্রতি ঘরে অন্তত দুই-তিন জন করে কাজ করার সক্ষমতা থাকলেও বাগানে কাজ মাত্র একজন করে। কোনো কোনো পরিবারের কাজ আবার অস্থায়ী। তাদের দৈনিক বেতন মাত্র ৮৫ টাকা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্যানিটেশনও অপ্রতুল।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাখন লাল কর্মকার বলেন, এখন চা শ্রমিকদের মূল দাবি তাদের ভূমি অধিকার এবং ২০ মে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতি প্রধান করা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, বর্তমানে দ্রব্যমুল্যের উর্ধগতিতে শ্রমিকদের অবস্থা খুবই খারাপ। শ্রমিকরা যে ১২০ টাকা মজুরি পান, সেটা তাদের জিনিসপত্র ক্রয় করার ক্ষমতার বাইরে। মালিকপক্ষের সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে মজুরি বৃদ্ধি করার। সেই চুক্তি অনুযায়ী দ্রুত মজুরি বৃদ্ধি করা দরকার। মজুরি বৃদ্ধি না হলে শ্রমিকরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতি লাগাম টেনে ধরতে সরকারের কাছে আহবান জানাচ্ছি আমরা।
শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেটের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী বলেন, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বাগান মালিকরাও কাজ করছেন। বর্তমান বেতন ১২০ টাকা হলেও এর সঙ্গে ঘর, চিকিৎসা, রেশন, জ্বালানি সংযুক্ত করলে তাদের বেতন পড়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ টাকা। প্রতি দুই বছর পর পর চা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে মালিক পক্ষের দ্বিবার্ষিক চুক্তি হয়। এ সময় বাধ্যতামূলক বেতন বাড়ানো হয়। আগামী চুক্তিতেও বেতন বাড়বে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. এ কে এম রফিকুল হক বলেন, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুদানের পরিপ্রেক্ষিতে চা বাগানের শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষার মান উন্নয়নে বাংলাদেশ চা বাগান শ্রমিক শিক্ষা ট্রাস্ট গঠিত হয়। ট্রাস্ট গঠনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ হাজারের অধিক শ্রমিক সন্তানদের বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে অনান্য সুবিধাও অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।