মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষ্যে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কবর জেয়ারত, পুষ্পমাল্য অর্পণ, খতমে কোরআন, মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী রণি, আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী, সভাপতি অধ্যাপক এম.এ মান্নান চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ মালেক কর্মসূচিতে সকলকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
শুক্রবার সকালে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি নিজ পিতার কবরে শ্রদ্ধা জানাবেন বলে জানিয়েছেন ভূমিমন্ত্রীর একান্ত সচিব রিদোয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম।
কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নব নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী জানান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এমপি মহোদয়ের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকীতে কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল ও নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আনোয়ারার হাইলধরে মরহুমের গ্রামের বাড়ির বাবুর কবরে পরিবারের পক্ষ থেকে খতমে কোরআন, মিলাদ মাহফিল ও পুষ্পমাল্য অর্পণসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হবে।
এছাড়া কর্ণফুলী-আনোয়ারা উপজেলা পরিষদ, উপজেলা আওয়ামী লীগ, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ, স্বেচ্চাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, অঙ্গসংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পৃথক পৃথক কর্মসূচি পালন করবে।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের এদিনে গণমানুষের নেতা বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ইন্তেকাল করেন। আনোয়ারা-কর্ণফুলীবাসী সুখ-দু:খের সাথী আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় কিংবা দুর্যোগ দুর্বিপাক-এলাকাবাসীর জন্য সবসময় ছায়া হিসাবে ছিলেন। নেতৃত্ব, জনপ্রিয়তা আর কর্মগুণে নিজের নামের চেয়ে বাবু মিয়া নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন এলাকাবাসীর কাছে।
আজ শত-সহস্র ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন আর নানা কর্মসূচিতে প্রিয় নেতা বাবু মিয়াকে স্মরণ করছে।
আখতারুজ্জামান বাবু রাজনীতিক, শিল্পোদ্যোক্তা, সংগঠকসহ জীবনের নানা ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়াও জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।
১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি আইনজীবী ছিলেন। তাঁর মাতার নাম খোরশেদা বেগম। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি বোয়ালখালী উপজেলার মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নুর নাহান জামানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঐ বছরই ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। ওখান থেকে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন।
১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন বাবু । ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথম লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি ৭২সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী। স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১এবং ২০০৯ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরবর্তীতে দলের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন।
কেবল রাজনীতিতেই নয়, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন।