বঙ্গবন্ধু মৎস হেরিটেজ হালদা নদীর পাড় কেটে মাটি বিক্রি ও ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে মৎস্য প্রজনন ও নদীর জীববৈচিত্র্য। হালদার পানি কমে যাওয়ায় নদীর মাঝখানে কৃত্রিম বাঁধ তৈরি করে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে রাতদিন চলছে বালু উত্তোলন ও মাটি পাচারের প্রতিযোগিতা। ফটিকছড়ি উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের ফকিরাচাঁন গ্রামের চিতাখোলা নামক স্থানে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু পাচারের ফলে পার্শ্ববর্তী রাস্তা বিলিন হয়ে কৃষিজমিও ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকায় প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে এসব বালু উত্তোলন ও মাটি কাটছে সিন্ডিকেটটি। যার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হলেও প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না। এদিকে উপজেলা প্রশাসন বারবার অভিযানের পরও থামানো যাচ্ছে না বালু উত্তোলন ও মাটি পাচার।স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে ওইসব এলাকার রাস্তাঘাট ভেঙে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক স্থান থেকে দীর্ঘদিন বালু তোলার ফলে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, হালদা নদীতে মাটি ও পুরানো ইট ফেলে রীতিমত 'বাঁধ দিয়ে' যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করে বালু উত্তোলন ও নদীর পাড়ের ভিতরের মাটি কেটে পাচার করা হচ্ছে। এতে নদীর গর্ভে চলে যাচ্ছে সরকারের ১৫৩ কোটি টাকার ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধ। কিছু কিছু স্থানে ফসলি কৃষি জমিও ভেঙে নদীতে বিলিন হচ্ছে। অতিরিক্ত বালু বোঝাই করা গাড়ী চলাচলের ফলে নষ্ট হচ্ছে এলাকার রাস্তাঘাট।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী সাবেক ইউপি সদস্য বদিউল আলম প্রকাশ বদি মেম্বার ও তার ছেলে সাদ্দাম হোসেন দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ বালু পাচারের কাজে জড়িত রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা কথা বলার সাহস পান না। যারা এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তাদেরকে মারধরের স্বীকারও হতে হয় বলে জানান নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা। এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা উভয়ে বালু উত্তোলন ও মাটি পাচারের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
দুর্গম এলাকা হওয়ায় অভিযানের আগেই ঘটনাস্থল থেকে ছিটকে পড়ে বালু ও মাটিখেকোরা। স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) এক জায়গায় বালু তোলা বন্ধ করলে উত্তোলনকারীরা অন্য জায়গায় বালু তোলা শুরু করে। আবার অভিযান চালিয়ে মেশিন বা সরঞ্জামাদি জব্দ করা হলেও, উত্তোলিত বালু বিক্রিতে বাধাগ্রস্ত হতে হয় না এ অসাধু চক্রের। এসব বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন জায়গা থেকে বালু তোলেন এবং দিন-রাতে ট্রাক, পিকআপসহ বিভিন্ন গাড়িতে করে বিক্রি করে আসছে।
জানতে চাইলে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, এভাবে নদীতে 'কৃত্রিম বাঁধ' তৈরি করে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ কমে যায়। ফলে নদীর ক্ষয় বেড়ে গিয়ে নদীর পাড় ভাঙন ত্বরান্বিত করে। এছাড়া অতিরিক্ত বালি উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশের বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। যার প্রভাবে তলদেশে বসবাসকারী উদ্ভিদ ও প্রাণিগোষ্ঠীর আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হবে তেমনি ধ্বংস হয়ে যাবে এদের খাদ্যের উৎসগুলো। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মৎস্য সম্পদের প্রজনন প্রক্রিয়ায়। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে পানিদূষণসহ নদীর গঠন প্রক্রিয়া পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং কমে যাবে নদী পাড়ের মাটির গুণাগুণ ও কর্মদক্ষতা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, 'বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার হালদা থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এভাবে যারা অবৈধ বালু উত্তোলন করে নদীর জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে পড়ছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের যথাযত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান এ হালদা গবেষক।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বির রাহমান সানি বলেন, 'অবৈধভাবে হালদা নদী থেকে বালু উত্তোলন করার কোন সুযোগ নেই। ওই স্থানে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।'