প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। বাংলাদেশের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখান থেকে মৎস্যচাষিরা পোনার বদলে রুই মাছের নিষিক্ত মাছের ডিম সংগ্রহ করে।
সম্প্রতি এ নদীর গুরুত্ব বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করে সরকার।
এ নদীকে রক্ষায় প্রায় প্রতিদিনই উপজেলা প্রশাসন ও নৌ পুলিশের অভিযান চোখে পড়ার মতো। কোনো দিন ১ হাজার মিটার তো অন্যদিন ৩ হাজার মিটার জাল জব্দ করেন তারা। শাস্তিও পেয়েছেন অনেকেই। বালু উত্তোলনের নৌকা হারিয়েছেন বেশিরভাগ বালুখেকোরা।
এত অভিযানের পরেও হালদা নদীতে গত ১৪ দিনে ৩টি ডলফিন ও ৩টি ব্রুড কাতলা মাছ মরে ভেসে ওঠার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ১৪ দিনে ৩টি ডলফিন ও ৩টি ব্রুড মাছ মারা গেছে। এটি এ নদীর জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের স্বাদু পানির মেজর কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। দূষণ, কেমিক্যাল প্রযোগ আর জাল পাতার কারণে ডলফিন ও মাছের মৃত্যু হয়েছে। হালদা বাস্তুতন্ত্র মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু বর্তমানে হালদার বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশ ও প্রতিবেশ জলজ প্রাণীর জন্য ক্রমশ হুমকি হয়ে উঠছে।
জানা গেছে, গত সোমবার ব্রুড কাতলা মাছের একটি মরে ভেসে ওঠে কাগতিয়া স্লইসগেট এলাকায়। এটির ওজন ৯ কেজি ১০০ গ্রাম। এরপর মঙ্গলবার হাটহাজারীর গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকা থেকে উদ্ধার করা মরা মাছটির ওজন ১২ কেজি ৩০০ গ্রাম। একইদিন বিকেলে সর্তার ঘাটে ভেসে উঠে আরেকটি মাছ। এটির ওজন ১০ কেজি ৭৭২ গ্রাম। এর আগে ডলফিন মরে ভেসে উঠে গত ১৪ জুলাই দক্ষিণ গহিরার বুড়ি সর্তা খাল, ২০ জুলাই আজিমারঘাট ও তৃতীয়টি ২১ জুলাই আজিমারঘাট এলাকায়।
উপজেলা প্রশাসনের অভিযান
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিদুল আলমের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ২০২১ সালের ১১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৮টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে প্রায় ৯০ হাজার ৫০০ মিটার ঘেরজাল জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও ভাসান জাল জব্দ হয়েছে ২৫ হাজার মিটার। হালদা নদীতে অবৈধভাবে ঘেরজাল, ভাসান জাল ও বড়শি বসানোর কাজে ব্যবহার করা ১৬টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা জব্দ করা হয়। এরমধ্যে ৪টি উপজেলা প্রশাসনের কাছে জব্দ রয়েছে। বাকিগুলো মুচলেকা ও জরিমানা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও মাছ ধরার নৌকা জব্দ করা হয় ৩টি। ২টি ধ্বংস করা হয়েছে বাকিটি মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
জরিমানা আদায় করা হয় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। একটি ১৫ কেজি ওজনের মা মাছ উদ্ধার করেন তিনি। এছাড়াও একটি মা মাছ জীবিত উদ্ধার করে অবমুক্ত করা হয়।
হালদা নদীর পাড় থেকে মাটি কাটার কাজে ব্যবহৃত ২টি ট্রাক্টর জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। এসব অভিযানে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। একজনকে ১৫ দিন ও অন্যজনকে ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হালদা নদীতে অবৈধভাবে মাছ শিকারের কাজে ব্যবহার করা ৩৩১টি বড়শি ধ্বংস করা হয়।
নৌ পুলিশের অভিযান
কর্ণফুলী নদী ও হালদার মোহনা থেকে গত জুন মাসে নৌ পুলিশের ৬০টি অভিযানে প্রায় ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৪৫০ মিটার জাল জব্দ করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য ২ কোটি ৫৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এছাড়াও ঠেলাজাল জব্দ করা হয়েছে ৫টি। চিংড়ি মাছের রেণু পোনা উদ্ধার করা হয়েছে ৯ লাখ ৯০ হাজার। যার বাজার মূল্য ১ কোটি ৫০ হাজার টাকা।
এছাড়াও হালদা নদীর রামদাস মুন্সিরহাটে অস্থায়ী নৌ ক্যাম্প পুলিশের গত জুন মাসে ১০টি অভিযানে ৬০ হাজার মিটার জাল জব্দ করা হয়।
সদরঘাট নৌ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি এবিএম মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিদিনই আমাদের দুটি টিম হালদা নদীতে অভিযান পরিচালনা করে। এ নদী রক্ষায় আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা রয়েছে। এরপরেও হালদা রক্ষায় আমরা আরও কঠোর হবো।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিচার্স ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, মাছ চোর চক্র সবার নজর এড়িয়ে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সুযোগ বুঝে জাল পাতার পাশাপাশি মাছ মারার জন্য হালদা ও শাখা খালে কেমিক্যাল প্রয়োগ করছে। গত দুদিনে ভেসে ওঠা ৩টি ব্রুড কাতলা মাছ দেখে ধারণা করা হচ্ছে রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় মারা গেছে মাছগুলো। হালদাকে বাঁচাতে হলে হালদাপাড়ের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এই নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখন নদীর ওপর নজরদারি বাড়িয়ে কারা জাল পাতে, কারা বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরছে তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিদুল আলম বলেন, হালদা নদী রক্ষায় আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। রাত হোক দিন হোক যখনই খবর পাই হালদা নদীতে কুচক্রী মহল অবৈধভাবে মাছ শিকার করছে তখনই ছুটে যাই। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। এরপরেও তারা নতুন পদ্ধতিতে মাছ শিকার করছে। এবার তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হবো।