রাজনৈতিক,সামাজিক বা অন্য কোন অজ্ঞাত কারনে প্রকৃত দেশ প্রেমিক যার যোগ্যতা,অবদান থাকার পর ও যখন কোন না কোন কারনে তাকে যথাযত সম্মান বা স্বীকৃতি দেওয়া হয় না,তাঁর দেশ প্রেমের অবদানকে অস্বীকার করা হয় বা আগামী প্রজম্মের নিকট তা গোপন করা হয় তখন সে হয় ষড়যন্ত্রের শিকার আর তখনই সে হয় অবহেলিত,উপেক্ষিত।
অবহেলিত ও উপেক্ষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহাবীর ছিলেন হাবিলদার রজব আলী খাঁ।
২০০ বছর পরাধীন থাকার পর আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন মুলত অকল্পনীয় ও অসম্ভব ছিল সে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আমাদের সকল সুর্যসন্তানরা। শত সহস্র বিপ্লবীর দীর্ঘ লড়াই ও তাঁদের আত্মত্যাগের ফলে মুলত আমাদের আজকের এই স্বাধীনতা।
জানা যায়,আমাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা ১৯০ বছর প্রত্যেক্ষভাবে বাংলাদেশসহ পুরো ভারতবর্ষকে শোষণ করেছিল।তারা লুটপাট করেছে,পাচার করেছে আমাদের সব সম্পদ।হত্যা,জেল-জুলুম নির্যাতন করে,নির্বাসন দিয়ে,ফাঁসি দিয়ে তারা তখন মহা আনন্দে মেতেছিল।
বৃটিশ সরকারকে ঐ সময়ে হিন্দুরা ও উচ্চ বর্নের জমিদাররা সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করেছিল। তখন তারা মুসলমানদের জীবন ও সম্পদ হরণে লিপ্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৩২ সালের ৭ই ডিসেম্বর লিখেছিলেন,বৃটিশদের হাতে ভারতের শিল্পগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে তাঁতিরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল,এদের প্রায় সকলেই ছিল মুসলমান।
আমরা জানি, ভারতের অন্যান্য সব প্রদেশের চেয়ে বাংলাদেশেই মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বেশি।
তখন হিন্দুরাই একমাত্র জমিদার ছিল।তারা মহাজন সেজে গ্রামের গরীব অসহায়দেরকে টাকা ধার দিয়ে তাদের ঘাড়ে চেপে বসে রক্ত শুষে নিতো ও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করতো।অনেকের মতে,হিন্দু আর মুসলমানের বিবাদের সুত্রপাত তখন থেকে শুরু।
উচ্চবর্ণের হিন্দু ও জমিদারদের সর্দার ছিলেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বৃটিশদের প্রশংসায় লিখেছেন,জনগণ মন অধিনায়ক,জয় হে,বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না সহ অনেক গান ও প্রবন্ধ।ইতিহাসবিদরা মনে করেন,পলাশিতে বর্ণহিন্দুদের শঠতা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও চক্রান্তে বাংলার স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।
পরবর্তী ১০০ বছর বিক্ষিপ্তভাবে চলে স্বাধীনতা সংগ্রাম। ফকির বিদ্রোহ,শহিদ তিতুমিরের স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ নানা সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়,শক্তি,সাহস জোগায় এই দেশের স্বাধীনতা কামী মানুষ।
স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুসলমানদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়।ঐ সময় হিন্দুরা মুলত বৃটিশদের সহায়ক শক্তি ছিল।কেননা হিন্দু, শিখ,বৃটিশ মিলে তারা সাইয়েদ আহমদ ও শাহ ইসমাইলের মুজাহিদ আন্দোলনকে নানা কৌশলে স্তব্ধ করে দেয়। ঐ সময় জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র বৃটিশদের সাথে ঐক্য করে নিসার আলির মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম কে বানাচাল করে দেয়।
নিভিয়ে দেয় তিতুমির,মাসুম সহ অনেকের জীবন প্রদীপ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অমলেন্দু দে বলেন, ‘মনে রাখা দরকার, মুসলিম বিপ্লবীরাই মুলত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংঘবদ্ধভাবে ভারতবর্ষ হতে ইংরেজ বিতাড়নের জন্য দীর্ঘকালব্যাপী এক সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।
(সূত্র : অমলেন্দু দে : বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, পৃ ১২৯)।
অন্যদিকে ১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ভারতবর্ষের মুক্তিকামী নেতা বৃটিশ সরকার উৎখাতের ডাক দেয়। তখন বর্ণহিন্দুরা বৃটিশরাজকেই সমর্থন দেয়। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী অনির্বাণ বন্দোপাধ্যায় বলেন, ১৮৫৭ সালে মহাসংগ্রামের ব্যর্থতায় বাংলার অ-মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। ‘’আরো জানা যায়,কবি ঈশ্বর গুপ্ত ঐ সময় লিখেছিলেন “যবনের যত বংশ এবারে হবে ধ্বংস/ সাজিয়াছে কোম্পানির সেনা/গোরু জরু লবে কেড়ে, চাপ দেরে যত নেড়ে/এই বেলা সামাল সামাল"।
তিনি আরো অগ্রসর হয়ে ঐ সময়ে লিখেছেন,চিরকাল হয় যেন বৃটিশের জয়/বৃটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়/এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়/শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রামরাজ্য কয়।” তাহাছাড়া ঈশ্বর গুপ্তের একটি জনপ্রিয় স্লোগান তৎকালে ইংরেজ অনুরাগী এবং বিপ্লব-বিরোধীরা জনমত গঠনের লক্ষ্যে প্রচার করেন :
“ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়/মুক্ত মুখে বল সবে বৃটিশের জয়।”
এরপর ও মুক্তিকামী মানুষের প্রানের দাবি ছিল আমাদের স্বাধীনতা।সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অবহেলিত ও উপেক্ষিত মহাবীর ছিলেন হাবিলদার রজব আলী খাঁ।
বৃটিশ ভারতের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক ছিলেন তিনি।সবার নিকট হাবিলদার রজব আলী নামে যিনি পরিচিত ছিলেন।
তিনি ১৮৫৭ সাথে সিপাহী বিপ্লবের সময় চট্টগামের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। ব্রিটিশ জেলখানায় আক্রমণ করে সকল বন্দীকে তিনি মুক্ত করে।হাবিলদার রজব আলীর পরিচয় কিছুটা অস্পস্ট। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ এবং গবেষকরা ধারণা করেছেন তিনি সন্দীপ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।
তরুন বয়সে সিপাই হিসেবে যোগ দেন এবং বিদ্রোহের পূর্বে তিনি ৪ নম্বর কোম্পানীর হাবিলদার পদে উত্তির্ন হন।
ইংরেজ সেনাবাহিনীর ৩৪ নম্বর নেটিভ বেঙ্গল পদাতিক বাহিনীর ১২০ জন হাবিলদার ছিলেন।হাবিলদার রজব আলী তাদের একজন।জানা যায়,ক্যাপ্টেন পিএইচকে ডিউলের অধীনে চট্টগ্রাম পাহাড়তলী সংলগ্ন প্যারেড গ্রাউন্ডের সেনানিবাসে হাবিলদার রজব আলী বসবাস করতেন।স্বাধীনতা সংগ্রামে দীর্ঘ তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অথচ দুর্ভাগ্য জনক হলে সত্য এই মানুষের নামটি মুছে যাচ্ছে মানুষের অগোচরে।
গত এক দশক ধরে স্বনামধন্য "আমরা চাটগাঁবাসী" সংগঠনের অঙ্গ সংগঠন হাবিলদার রজব আলী স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হাবিলদার রজব আলী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশে হাবিলদার রজব আলী খাঁর জীবন,স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
আমাদের ব্যর্থতা,আমাদের উদাসীনতা অবহেলায় সময়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে সংগ্রামী এই মানুষটি।ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হাবিলদার রজব আলী খাঁ একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে থাকবে। পৃথিবীর স্বাধীনতা মুক্তিকামী মানুষ তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
১৮ নভেম্বর ১৮৫৭ ইং তারিখে রাত ৯ টা নাগাদ চট্টগ্রামের রজব আলির নেতৃত্বে সিপাহীরা গুলি ছুড়ে বিদ্রোহ করে।জেলের তালা ভেঙে সিপাহীরা কয়েদীদের মুক্ত করেন।
এরপর তারা আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে আশ্রয় নেন।চট্টগ্রামে সিপাহীদের এই সংঘবদ্ধ বিদ্রোহে সেখানকার ব্রিটিশরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং চট্টগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রের বুকে জাহাজে আশ্রয় নেন।
এর ফলে চট্টগ্রাম সম্পূর্ণ ভাবে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে পড়ে। টানা ৩০ ঘণ্টা চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ মুক্ত রাখার পর ১৯ নভেম্বর ভোর রাতে সিপাহীরা রজব আলির নেতৃত্বে পিলখানা থেকে হাতি নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। চট্টগ্রাম ত্যাগ করার আগে সিপাহীরা চট্টগ্রাম মাঠে একত্রিত হন।
বর্তমানে এই মাঠ চট্টগ্রাম প্যারেড গ্রাউন্ড নামে চিহ্নিত।
অবশেষে চট্টগ্রাম ৩০ ঘণ্টা বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয় বটে তবে পরবর্তীতে হাবিলদার রজব আলীর মৃত্যু হয় নির্মমভাবে।চট্টগ্রামকে মুক্ত করার পর বিদ্রোহীরা স্থির করেছিল যে, তারা ত্রিপুরার নিরাপদ অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেবে।
বিদ্রোহী সিপাইদের পরিচালনার ভার তখন এসে পড়ল হাবিলদার রজব আলী খাঁর উপরে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন পি এইচ কে ডেওলের রিপোর্টে স্থানীয় সূত্রের বরাতে বলা হয় রজব আলী বিদ্রোহী বাহিনীকে নিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে ত্রিপুরা সীমানার দিকে যাত্রা করেছেন।
তবে তার আগেই চট্টগ্রামের কমিশনার ত্রিপুরা রাজার কাছে সংবাদ পাঠালেন,বিদ্রোহী সিপাইদের প্রতিহত করার জন্য।
ত্রিপুরার রাজা ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে বিদোহীদের ঠেকানোর জন্য প্রস্ততি নেয়।
বিদ্রোহীরা সীতাকুন্ড হয়ে ২রা ডিসেম্বর তারিখে ‘স্বাধীন’ ত্রিপুরার প্রবেশদ্বারে গিয়ে পৌঁছলো। পৌঁছার সাথে সাথে তারা লেপটেন্যান্ট রসের নেতৃত্বে অতর্কিত হামলার শিকার হলেন।
হাবিলদার রজব আলী তার অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হন কিন্তু ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পরাজিত হন।
জানা যায়, অনেক বিদ্রোহী সিপাই মারা যায়। এরপরেও আহত হয়ে এবং ক্ষুধা যন্ত্রনায় মারা যায় আরো অনেক সৈন্য। হাবিলদার রজব আলী সহ তিন বা চারজন সিপাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ইংরেজ বাহিনীর অব্যাহত অনুসরনের মুখে তারা গহীন পাহাড়ী জঙ্গলে হারিয়ে যান।লোকচক্ষুর অন্তরালেই একসময় হাবিলদার রজব আলীর জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
এই মহাবীর কে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ উচিত এবং তাকে নিয়ে আরো গবেষণা হওয়া উচিত তাঁর অবদান পৃথিবীর মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষ সারাজীবন স্মরণ করুক সেই প্রত্যাশা করছি।
লেখক -
মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম।
কবি,প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী।