আজ রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সমুদ্রতীরে পাহাড় কেটে সরকারি কর্মচারীদের আবাসন

ইমাম খাইর, কক্সবাজার : | প্রকাশের সময় : সোমবার ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:২৪:০০ অপরাহ্ন | কক্সবাজার প্রতিদিন
  • উচ্চ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষিত
  • তদন্তে সীমাবদ্ধ পরিবেশের মামলা 

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কোলঘেঁষা হোটেল-মোটেল জোনে বহুল আলোচিত ৫১ একর পাহাড় কাটা এখনো বন্ধ হয়নি। চলছে জমি কেনাবেচা। বাস্তবায়ন হচ্ছে না উচ্চ আদালতের নির্দেশ। সরকারি জমি বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশের মামলা থাকলেও তদন্ত সীমাবদ্ধ। 

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, পাহাড়ি বনভূমিতে আবাসনের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এই আইন ভঙ্গ করছেন খোদ সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীরা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গড়ে তুলছেন আবাসন প্রকল্প। প্রতিদিনই দেদার কাটা হচ্ছে পাহাড়। 

অথচ এ প্রকল্পটি বাতিলের পাশাপাশি ওই বনভূমি এলাকার সব বসতি উচ্ছেদ করতে এক দশক আগে কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। তবে এখনও জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে এ বিষয়ে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে কক্সবাজারের কলাতলীসংলগ্ন ঝিলংজা মৌজার ১২৪ একর ভূমিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে সরকার। ৫১ একর জমি নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকল্পটি এই এলাকার মধ্যে পড়েছে। ২০০৩ সালে জেলা প্রশাসকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ওই আবাসন প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়। 

জেলা প্রশাসনের ওই প্রকল্পে ৫০০টি প্লট রয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ২০০টি পরিবার ঘর তুলে বসবাসও করছে। অনেক কর্মকর্তা বরাদ্দ পাওয়া প্লট বিক্রি করে দিয়েছেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর একটি অংশ সেখানে বাস করছে। অনেকে ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। হোটেল-মোটেল এলাকার কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে ভাড়াও বেশি। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে পাহাড় কাটা বন্ধে ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট করে তারা। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ৮ জুন জেলা প্রশাসনের ওই প্রকল্পের বরাদ্দ বাতিল, পাহাড়ের কোনো অংশ না কাটা, সংরক্ষিত বন এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ ও বন ধ্বংস না করার আদেশ দেন।

আদালতের ওই রায় বাস্তবায়িত না হওয়ায় ১২ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করে বেলা। আদালত কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনকে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে সময় প্রার্থনা করেন তিনি। এ সময় তিন মাসের মধ্যে সব স্থাপনা উচ্ছেদ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন জেলা প্রশাসক।

সরেজমিন দেখা গেছে, চারদিকে টিন আর দেয়ালঘেরা জেলা প্রশাসনের আবাসন প্রকল্পের মূল ফটকের সামনে বিশাল সাইনবোর্ড। লেখা ‘সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা আবাসন, এই ৫১ একর জমি বর্ণিত আবাসনের জন্য সেলামি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।’

আবাসন প্রকল্পের উত্তর পাশে স্থাপনা নির্মাণের জন্য বিশাল পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে। ৮ থেকে ১০ শ্রমিক এ পাহাড় কাটছে। এ সময় কোনো শ্রমিক কথা বলতে রাজি হননি। 

আবাসন প্রকল্পে পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, ‘পাহাড়টি কাটছেন আমাদের সমিতির এক সদস্য, তিনি এখন চাকুরি থেকে অবসরে গেছেন।’

এ প্রসঙ্গে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকারি কর্মকর্তার কাজ রাষ্ট্রের আইন মানা ও তা বাস্তবায়ন করা। তবে কক্সবাজারে আমরা তার উল্টো অবস্থা দেখি। উচ্চ আদালতের রায় থাকার পরও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ওই ৫১ একরের আবাসন প্রকল্পটির স্থাপনা উচ্ছেদ করছে না। এতে বেসরকারি খাতের দখলদাররা আরও আগ্রাসী হয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এ আবাসন প্রকল্পের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগে এক বছর আগে মামলা করা হয়েছে। সেটা নিয়ে তদন্ত চলছে। এর মধ্যে আবার নতুন করে কেউ পাহাড় কাটলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. জাহিদ ইকবাল বলেন, পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশ লাগে না, দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কে কাটছে তা শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।