"মুক্তিযুদ্ধে অসামন্য অবদান রাখায় ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে নগদ এক হাজার টাকা দেয়। পুলিশের চাকুরির প্রস্তাবও দেয় বঙ্গবন্ধু। কিন্তু আমি লেখাপড়া তেমন করিনি বলে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেই। তারও আগে কক্সবাজার মহকুমা ট্রেজারি রক্ষা করায় আমাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ২৫০ টাকা পুরষ্কার দেওয়া হয়। আর সেই আমি দীর্ঘ ৮ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এখনও কোন সুরাহা হয়নি।" এভাবেই নিজের মনের অব্যক্ত বেদনা প্রকাশ করেছেন আশি বছর বয়সী কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের পূর্ব পোকখালী গ্রামের মৃত আহামদ মিয়ার ছেলে আমান উল্লাহ (আনসার কমান্ডার আমান উল্লাহ)। বর্তমানে কক্সবাজার পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের পশ্চিম নতুন বাহারছড়ার সপরিবারে বসবাস আমান উল্লাহর। তিনি দুঃখের সঙ্গে বলেন, "জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরে আনসার কমান্ডার হিসেবে বারবার সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছি। ২৫ মার্চ বিকেল হত্যা করেছি ১১ জন পাঞ্জাবিকে। দুই পুলিশের সাথে থেকে একসপ্তাহ মহকুমা ট্রেজারি রক্ষা করেছি। তবুও আমার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নেই। আছে হাজারো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম।" মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠতেই বৃদ্ধ আমান উল্লাহ চোখ জল জল করে উঠে। স্মৃতি হাতড়ে বলতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা। যুদ্ধে নিজের ভুমিকার কথা জানান দিতে গিয়ে আমান উল্লাহ বলেন, "২৫ মার্চ কালো রাতে যখন আমরা জানতে পারি পাকিস্তানি দোসররা আমাদের প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেছে। ঢাকায় নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। তখন আমরা কক্সবাজারের ৫০ জন আনসার সদস্য শহরের বিমানবন্দর সড়কের ইপিআর ক্যাম্প (বর্তমান স্কাউট ভবন) ঘেরাও করি। সেখান থেকে ভোর রাতে ১১ জন পাঞ্জাবিকে আটক করি। পরে ১নং সেক্টরের মেজর শওকতের নির্দেশে তাদের রামুর পানের ছড়া ঢালায় নিয়ে হত্যা করি। এর কয়েকদিন পরে মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক (মোজাম্মেল চেয়ারম্যান), এর নির্দেশে আমি ও আমার ১০ জন আনসার সদস্য চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরে যোগদান করি। সেখানে মেজর শওকতের নেতৃত্বে প্রায় একমাস যুদ্ধ করি। একটি সম্মুখযুদ্ধে ক্যাপ্টেন হারুন গুলিবিদ্ধ হলে তাকে নিয়ে আমরা মালুমঘাট হাসপাতালে আসি। সেখানে ক্যাপ্টেনের চিকিৎসা ব্যবস্থা করে আমরা সকলে ফাসিয়াখালি বনবিভাগের রেঞ্জ অফিসে (বর্তমান সেনবাহিনী ক্যাম্প) আসি। ওখান থেকে আমরা কক্সবাজার ফিরে আসি। তখন তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমা প্রশাসক মোঃ ছলেমান আমাকে জানায়, মহকুমা ট্রেজারী লুটপাট করার চেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তানি দোসররা। আমি যেন এর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকি। তাঁর নির্দেশে আমিও দুই পুলিশ সদস্য একসপ্তাহ ট্রেজারি পাহারা দেই। এরপর যুদ্ধ শেষ হলে আমি আনসারের চাকরি ছেড়ে দেই। তখন থানা থেকে আমার গ্রামের বাড়িতে চিঠি পাঠিানো হয়। আমি থানায় গেলে আমাকে ২৫০ টাকা পুরষ্কার দেয়া হয়। তার কিছুদিন পরে মরহুম মোজাম্মেল চেয়ারম্যান আমাকে নিয়ে ঢাকায় যায়। তখন বঙ্গবন্ধু আমার বীরত্বের কথা শুনে ১ হাজার টাকা নগদ দেয় এবং চাকরীর প্রস্তাব দেয়। সেই থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমার নাম মুক্তিযোদ্বার তালিকায় ছিল। কিন্তু তালিকা হালনাগাদের সময় অসুস্থতার কারণে আমি উপস্থিত থাকতে না পারায় আমি তালিকা থেকে বাদ পড়ি। তথন থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার। এজন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু বারবার গায়েব হয়ে যাচ্ছে আমার আবেদন।" এবিষয়ে চট্টগ্রারে কালুরঘাটের আমানের সাথে যুদ্ধ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল আহমদ (গেজেট নং ৪৯) বলেন, "আমান উল্লাহ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আনসার কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছেন।" জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার কামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, "আমান উল্লাহ যুদ্ধের সময় ১নং সেক্টরের নানা সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন।" এবিষয়ে কক্সবাজার জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সভাপতি মোস্তাক আহমদ চৌধুরী বলেন, "আমানউল্লাহ একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছেন। তার দলের কমান্ডার ছিলেন আবু তাহের। আমি তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছি।"