ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ বলেছেন, ভারত বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে তার যাত্রায় সহায়তা করতে এবং বৃহত্তর সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অংশীদার হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শুক্রবার (১৭ ডিসেম্বর) ভারতীয় সম্প্রদায় এবং ঢাকায় ভারতীয় বন্ধুদের জন্য এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ বলেন, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের এই ঐতিহাসিক ৫০তম বছরে আজ ঢাকায় আসতে পেরে আমি আনন্দিত। একজন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর সাথে দেখা করার আনন্দ ও সম্মানের পাশাপাশি, বাংলাদেশের জনগণের উষ্ণতা ও ভালবাসা আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়েছে।
তিনি বলেন, আপনাদের সঙ্গে দেখা করার ঠিক আগেই আমি ঐতিহাসিক রমনা কালী মন্দির থেকে ফিরেছি, যেখানে আমার সংস্কারকৃত মন্দির উদ্বোধন করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি একে মা কালীর আশীর্বাদ হিসেবে দেখি। আমাকে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ-ভারতের সরকার ও জনগণ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ধ্বংসকৃত মন্দিরটি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। দখলদার বাহিনীর হাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত হয়। এই মন্দিরটি ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতীক। এটি আমার বাংলাদেশ সফরের একটি শুভ সমাপ্তি ঘোষণা করবে।
গত বছর কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকে, এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর। আমি এই সফরকে সবচেয়ে সঠিক বলে মনে করছি, কারণ আমার প্রথম বাংলাদেশ সফর এই বিশেষ বছরে ঘটছে, যখন আমরা যৌথভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করছি। স্বৈরাচার থেকে স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশের জনগণের বিপুল ত্যাগের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আপনাদের অদম্য সাহসিকতাকে আমরা অভিনন্দন জানাই এবং আমি আপনাদের ভারতীয় বন্ধুদের এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর আত্মত্যাগের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই, যারা একটি নৈতিক কারণে তাদের প্রাণ দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ভারতীয়দের হৃদয়ে বাংলাদেশের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। আমাদের রয়েছে আত্মীয়তা, ভাগাভাগি করা ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রাচীন বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে রচিত এক অনন্য ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আমাদের সম্পর্ক দুই দেশের বিচক্ষণ নেতৃত্বের দ্বারা লালিত হচ্ছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শ্রদ্ধা নিবেদন করার সময় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জনগণ যে নৃশংসতা ও গণহত্যার মুখোমুখি হয়েছিল এবং নৃশংস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামের কথাগুলো আমার মনে পড়ছিল। আমি শ্রদ্ধা জানাই সেইসব হাজার হাজার নারীর প্রতি যাদের মর্যাদা লঙ্ঘন করা হয়েছিল এবং অসহায় বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি, শুধু সম্মানজনক জীবনযাপন করার আকাঙ্ক্ষা ছাড়া যাদের কোনো দোষ ছিল না এবং যাদের নির্যাতিত করা ও হত্যা করা হয়েছিল। আজ যেমন আপনাদের দেশ এই অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে, তেমনি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের লড়াই ন্যায়সঙ্গত ছিল। এই লড়াই ছিল মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার শক্তিকে পরাজিত করে অধিকারের শক্তির জয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ভারতও এই প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে। আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছে সেটিও এই প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের যৌথ গল্পে অবদান রেখেছে।
আমি আনন্দিত যে, উভয় দেশের নেতৃত্বই জানেন আমাদের প্রবৃদ্ধির গতিপথ পরস্পর সংযুক্ত এবং সম্পদ ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান হল টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্র। দুই সরকার আমাদের অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোকে শক্তিশালী ও মজবুত রাখার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে। আমি এটা জেনে আনন্দিত যে, আমাদের উভয় পক্ষ আমাদের প্রবৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং পরিবেশ-বান্ধব করার জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমি সবুজ শক্তি এবং পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও জোরদার করার বিশাল সম্ভাবনা দেখছি।
ভুটান এবং নেপালের সঙ্গে স্থল সীমানাও ভাগ করে নেওয়া একটি দেশ হিসেবে ভারত এই সত্যটি সম্পর্কে সচেতন যে, একটি সুসংযুক্ত এবং উন্নত সমন্বিত উপ-অঞ্চল আমাদের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং তাদের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নমূলক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই চেতনার আলোকে, ভারত বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে তার যাত্রায় সহায়তা করতে এবং বৃহত্তর সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অংশীদার হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি উভয় পক্ষের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে, বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং আমাদের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে আমাদের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংযোগ নতুন উচ্চতায় নেওয়ার জন্য এই সুযোগটি কাজে লাগাতে অনুরোধ করছি।
আমরা তরুণ জাতি হিসেবে ভাগ্যবান, যাদের উদ্যমী এবং সৃজনশীল জনগোষ্ঠী রয়েছে। তরুণরাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমাদের অবশ্যই এই জনসংখ্যাগত সুফল কাজে লাগাতে হবে, যাতে করে এটি জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারে। আমি এটা জেনে আনন্দিত যে, যুব বিনিময় এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি বিশ্বায়িত এই বিশ্বে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা তৈরিতে সহায়তা করবে।
আমি আজ এখানে উপস্থিত সকল ভারতীয় নাগরিককেও অভিনন্দন জানাই। আপনারা সবাই বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অসাধারণ কাজ করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি আপনারা আমাদের দীর্ঘস্থায়ী, ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেও দৃঢ় করেছেন। আমাদের অঞ্চলে সমৃদ্ধি এনে আপনারা ভারতকে গর্বিত করছেন। এই কাজগুলি করার সময়, আপনারা আমাদের দেশের মূল্যবোধ এবং রীতিরও অনুসরণ করেছেন, যা বাংলাদেশের সাথে আমাদের ভাগ করে নেওয়া যৌথ ঐতিহ্যেরও অংশ।
একটি প্রগতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজের বাংলাদেশের মৌলিক মূল্যবোধ বজায় রাখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম প্রধান অবদান। আমি রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে, ভারত এমন একটি বাংলাদেশকে সমর্থন করবে যা এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে আবির্ভূত মূল্যবোধগুলিকে তুলে ধরে।
আপনারা জানেন, বিশ্বের সকল অংশে ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা, কল্যাণ এবং মঙ্গল আমাদের সরকারের জন্য একটি অগ্রাধিকার। গত দেড় বছরে, কোভিড-১৯ মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময়ে সরকার বিশ্বের প্রতিটি কোণে আমাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ প্রচেষ্টা করেছে। আমাদের সরকার বিদেশে থাকা আমাদের নাগরিকদের সাথে, সেইসাথে আমাদের অভিবাসীদের সাথে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাবে। আমি এটা জেনে আনন্দিত যে, ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন আমাদের ‘বন্দে ভারত মিশন’ এবং দুর্দশাগ্রস্ত ভারতীয় নাগরিকদের জন্য অন্যান্য কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের অগ্রভাগে ছিল। যখন আমরা ভারতে ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ উদযাপন করছি, তখন আমি এখানে উপস্থিত আমাদের নাগরিকদের এগিয়ে আসতে এবং জাতি গঠনের লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব উপায়ে অবদান রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
আমি বাংলাদেশে আমাদের বন্ধুদেরকে আবারও আশ্বাস দিচ্ছি, ভারত আপনাদের অসাধারণ সদিচ্ছা এবং বন্ধুত্বকে মূল্যায়ন করে। আমরা ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত থাকার, যৌথভাবে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন এবং আমাদের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রত্যাশা করছি।
এই অনন্য বছরে, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং আমাদের বন্ধুত্বের ৫০তম বার্ষিকী এবং সেই সাথে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন করার সময়ে, আসুন আমরা আমাদের জাতির স্থপতিদের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেদেরকে পুনরায় উৎসর্গ করি। আমি আত্মবিশ্বাসী, ১৯৭১ সালে রক্ত ও আত্মত্যাগের ফলে তৈরি এ বন্ধন ভবিষ্যতেও আমাদের দেশ দুটিকে একসূত্রে বেঁধে রাখবে। মহামারির এই কঠিন সময়ে আমি আপনাদের সকলের সাফল্য এবং সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।