আজ শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১ই আশ্বিন ১৪৩১
ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ

ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন নাকচ সাদ মুসা গ্রুপের

Author Thedaily Shangu | প্রকাশের সময় : রবিবার ১০ এপ্রিল ২০২২ ০৮:৩৯:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

 

মাসুম বিল্লাহ ও জয়নাল আবেদিন: ঋণখেলাপি হিসেবে ব্যাংক খাতে সাদ মুসা গ্রুপ একটি পরিচিত নাম। একাধিক ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে পারছে না গ্রুপটি। সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংকের অন্যতম শীর্ষ খেলাপি সাদ মুসা গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্যাপ্ত ডাউন পেমেন্ট (এককালীন জমা) না দেয়ায় এ আবেদন নাকচ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রামের নিউমার্কেট করপোরেট শাখার দুটি ঋণ (ইউনিট ১ ও ২) মন্দ মানে খেলাপি হয়ে পড়েছে সাদ মুসা গ্রুপের। সুদে-আসলে দুই ঋণের সমন্বিত পরিমাণ ২৯৩ কোটি তিন লাখ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ন্যূনতম পাঁচ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট পরিশোধের বিধান রয়েছে। সে হিসেবে ২৯৩ কোটি টাকার ডাউন পেমেন্ট আসে ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। কিন্তু তারা জমা দিতে চায় সাত কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, গ্রাহক হিসেবে গ্রুপটির আগের রেকর্ড মোটেও ভালো নয়। এসব ঋণ পুনঃতফসিলের পর গ্রুপটি বাকি টাকা ফেরত দেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। তারা আরও জানান, অগ্রণী ব্যাংক ছাড়াও একাধিক ব্যাংকে গ্রুপটি ‘ইচ্ছাকৃত’ খেলাপি হিসেবে পরিচিত।

সাদ মুসার ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য অগ্রণী ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর পাঠানো আবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হলে ব্যাংকটির চট্টগ্রাম নিউমার্কেট শাখার ২৮৮ কোটি টাকার ঋণখেলাপি কমে আসবে। আবেদনপত্র থেকে আরও জানা যায়, করোনাকালে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কোনো সুবিধা নিতে পারেনি সাদ মুসা গ্রুপ। এছাড়া কিস্তির ২৫ শতাংশ জমা দিয়ে ঋণ অশ্রেণিকৃত দেখানোর সুবিধাও নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ সাত হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে দুই হাজার ৬১৮ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকটি। ডিসেম্বর শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল তিন হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে সাদ মুসা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ মহসিনের সঙ্গে একাধিক মাধ্যমে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এসএমএস বা খুদেবার্তা পাঠালেও তার উত্তর দেননি তিনি।

 খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকের প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় বেশি। যেমন নিয়মিত বা ভালো ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশন রাখতে হয় এক বা দুই শতাংশ। কিন্তু খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন জমা রাখতে হয়। ব্যাংকের স্বাস্থ্য রক্ষা ও আমানতকারীদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্যই প্রভিশন রাখার এ ব্যবস্থা। খেলাপি হওয়া ঋণ উদ্ধার করার সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে এর বিপরীতে নগদ টাকা প্রভিশন রাখার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত এ প্রভিশন রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংক নতুন বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কেননা দিন শেষে মূলধন থেকে তহবিল সরিয়ে তা প্রভিশন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র, আমানতকারী, শেয়ারহল্ডারসহ সবাই।

 

আবার বিদেশি ব্যাংকগুলো আমদানি নিষ্পত্তি করার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন রাখতে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংকের সঙ্গে ঋণপত্র খুলতে চায় না। তখন এসব ব্যাংকে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি করার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে গ্যারান্টি নিতে হয়। সাধারণত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বনামধন্য বিদেশি ব্যাংকগুলো এ ধরনের গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। এ জন্য আবার অতিরিক্ত ফি গুনতে হয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোকে। এর ফলে সংকটে থাকা ব্যাংকের আয় কমে যায়।

খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দুর্নীতি মোকাবিলার পাশাপাশি করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের মূলধন সংকটে থাকা ব্যাংক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে। যেসব বেসরকারি ব্যাংক এখন মূলধন সংকটে ভুগছে, সেগুলোয়ও একসময় বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছিল। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করা যেমন জরুরি, তেমনি বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে মুক্ত রাখতে হবে পরিচালকদের কবল থেকে। সরকারের সদিচ্ছা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্তিশালী তদারকি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী হতে পারে। এতে কমবে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণ।

এ ঋণটির বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সাদ মুসা গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ব্যবসায়িক গ্রুপটির ঋণ পরিশোধের আচরণ আগে ভালো ছিল, কিন্তু এখন তারা বিভিন্ন কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে সবাই মিলে সহযোগিতা করা উচিত। তবে সিআইবি ক্লিয়ার না থাকলে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই তা করা সম্ভব নয়। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিবেচনা করে ও তাদের সিআইবি ক্লিন হয়, তাহলে আমরা সহযোগিতা করতে পারব।’

প্রসঙ্গত, শুধু অগ্রণী ব্যাংক নয়, চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটি প্রায় ডজন খানেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, ফান্ড ব্যবস্থাপনার অভাব, করপোরেট সংস্কৃতি চর্চার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ডুবতে বসেছে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবসা। দেশের ১৪ ব্যাংক ও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাদ মুসা গ্রুপকে তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে এখন আর উদ্ধার করতে পারছে না।