জীবন ও জীবিকার তাগিদে ধারণক্ষমতার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি মানুষ বসবাস করছে ঢাকায়। সেই সঙ্গে পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে চলছে উন্নয়নকাজ। ফলে চাপ বাড়ছে ঢাকার পরিবেশের ওপর। সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটছে বায়ুর। ধুলোয় ধূসর ঢাকার বায়ুদূষণ দিন দিন বেড়েই চলছে। অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাসে এখন ভাসছে বিষ, যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকছে শরীরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে সারাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। তার মানে ঢাকায় বায়ুদূষণ না থাকলে একজন নাগরিক আরও প্রায় সাত বছর সাত মাস বেশি বাঁচতে পারতেন। সেই সঙ্গে বায়ুবাহিত রোগে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। কিডনি, হৃদরোগসহ ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। নষ্ট হচ্ছে নারী-পুরুষের প্রজনন ক্ষমতাও। অতি বায়ুদূষণের ফলে পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ুর। উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের ওজনস্তর। পরিবেশ দূষণরোধে আইন থাকলেও তা মানার বালাই নেই সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষেরই। নগরে মেগা উন্নয়নকাজে বায়ুদূষণরোধের কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বেশির ভাগ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানই সরকারি। পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা এদের বিরুদ্ধে কঠোর না হওয়ায় কমছে না বায়ুদূষণ।
অন্যদিকে, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সড়কে পানি ছিটানোর কথা বললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। বায়ুদূষণ রোধে নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ থাকলেও বাংলাদেশে তা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। বায়ুদূষণ রোধে নজরদারি না বাড়ালে বসবাসের অযোগ্য ও বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে নগরবাসীর জীবনে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ু পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১১৭টি দেশের মধ্যে বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে বিশ্বের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের মধ্যে রাজধানী ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রত্যাশিত বায়ুমানের প্রতিবেদনেও দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বাতাসের মান বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের আগের তুলনায় বাড়বে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
অন্যদিকে গত ১০ বছরে উন্নয়নকাজের ফলে রাজধানীতে বেড়েছে খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ। বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণাধীন স্থাপনা ও কলকারখানার বর্জ্য, নিয়মিত রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করাসহ নানা কারণে দূষিত হচ্ছে ঢাকার বাতাস।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিনিয়তই বাড়ছে ঢাকায় বায়ুদূষণ। ফলে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, হৃদরোগ, অ্যাজমাসহ নানা ব্যাধি নিয়ে হাসপাতালে বাড়ছে রোগী। বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার ও ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টস বায়ুতে মিশে যাচ্ছে। এতে উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ু। আর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ঢাকা নগরী। মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযানের অনিয়ন্ত্রিত কালো ধোঁয়ায় সৃষ্ট মিথেন গ্যাস, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণীদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া বা সালোক সংশ্লেষণ অতিরিক্ত বায়ুদূষণের ফলে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পুরো প্রাণী জগতের ওপর পড়ছে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে ধুলোবালি এবং শিল্পকারখানার ধোঁয়া বেড়ে যাওয়ায় বাতাসের মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে দূষণের যে মাত্রা তাতে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। বাতাসে ভাসছে বিষ। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণা অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যত শিশুকে অভিভাবকরা ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের ৪৯ শতাংশ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত।