# টেরি বাজারে ব্যবস্যায় মন্দার শংকা
# খাতুনগঞ্জেও ব্যবস্যায়ীদের চিন্তার ভাজ
# মুদ্রণশিল্পের ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন দুঃশ্চিন্তায়
করোনার কারণে দুই বছর মন্দার পর এবারের ঈদে ভালো ব্যবসার স্বপ্ন বুনছিলেন চট্টগ্রামে পাইকারী কাপড়ের প্রধান বাজার ‘টেরিবাজারে’র ব্যবসায়ীরা। সেই স্বপ্নে হঠাৎ ছন্দপতনের শঙ্কা হয়ে এসেছে লালদীঘি সড়ককে ঘিরে তিনদিনের বৈশাখী মেলা ও বলীখেলা আয়োজনের ঘোষণা। নগরীর ভোগ্যপণ্যের অন্যতম প্রধান পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জেও রমজানকে ঘিরে চলছিল ভালো বিকিকিনি। বৈশাখী মেলার আয়োজনের খবরে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে এই বাজারের ব্যবসায়ীদেরও।
শুধু কাপড় ও ভোগ্যপণ্যই নয়, তৃতীয় আরেকটি খাত- আন্দরকিল্লার মুদ্রণশিল্পের ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন দুঃশ্চিন্তায়। পাশাপাশি চট্টগ্রামে বই বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজার হওয়ায় আন্দরকিল্লার লাইব্রেরি ব্যবসায়ী এবং আন্দরকিল্লা-টেরিবাজারকেন্দ্রীক টেইলারিং ব্যবসায়ীরাও আছেন ব্যবসা কমে যাওয়ার শঙ্কায়। সবমিলিয়ে লালদীঘি সড়ককে ঘিরে তিনদিনের এই আয়োজনে ভরা মৌসুমে ‘হঠাৎ’ সংকট দেখছেন নগরীর পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ খাতের ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, এবারের রমজানের মাঝামাঝি সময়ে জমজমাট বেচাকেনা চলছে দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। ঈদকে টার্গেট করে আরেকদফা বাজার চাঙ্গা হওয়ার অপেক্ষা এখানকার ব্যবসায়ীদের। এর ১০০-গজ দূরের দেশের অন্যতম বৃহৎ কাপড়ের বাজার টেরিবাজারেও চলছে ঈদের বেচাকেনা। একই এলাকার জহুর হকার্স মার্কেট, আন্দরকিল্লায় মুদ্রণশিল্প (প্রিন্টিং প্রেস), লাইব্রেরি ও টেইলারিং ব্যবসায়ীরাও করোনা কাটিয়ে এ বছরের রমজানে ভালো ব্যবসা করছেন। কিন্তু লালদীঘিতে সড়কেই আসন্ন আবদুল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা আয়োজনের প্রস্তুতির কথা শুনে আঁতকে উঠেছেন এখানকার অনেক ব্যবসায়ী।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রখ্যাত এই এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, গেল দু’বছর করোনার কারণে বেচাকেনা সেভাবে হয়নি। এবার ভালো বেচাকেনার আশায় নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করেছেন তারা। কিন্তু লালদীঘি মাঠে সংস্কার কাজ চলমান থাকায় মূল সড়কেই এবার জব্বারের বলীখেলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আর ফুটপাতে বসবে মেলার আয়োজন। যাকে কেন্দ্র করে চরম যানজট সৃষ্টি হতে পারে ওই সড়কে। ২২ থেকে ২৪ রমজান (২৪ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল) পর্যন্ত সড়কে মেলার আয়োজন থাকায় ব্যবসায় ভাটা পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। এতে করে শেষমুহূর্তে আর্থিক ক্ষতির সামনে পড়তে পারেন ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে মেলার আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লালদীঘি মাঠকে কেন্দ্র করে চারপাশের ফুটপাতে মেলা বসবে ২৪ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। মেলাকে কেন্দ্র করে সড়ক বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে জব্বারের বলীখেলার দিন অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল আন্দরকিল্লা থেকে লালদীঘি পর্যন্ত সড়ক বন্ধ রাখার প্রস্তাবনা আছে। সেদিন লালদীঘি মোড়ের জেলা পরিষদ চত্বরে সড়কে বলীখেলার মঞ্চ তৈরি করা হবে।
জানতে চাইলে মেলা কমিটির সভাপতি ও কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী বলেন, এবারের মেলায় সড়ক বন্ধ করা হবে না। শুধুমাত্র বলীখেলার দিন (২৫ এপ্রিল) সড়ক বন্ধ থাকবে। দুইপাশের ফুটপাতে মেলার স্টল বসানোর পরিকল্পনা করছি আমরা।
এদিকে গত দুই বছর ধরে করোনার প্রকোপের কারণে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ মেলার আয়োজন হয়নি। এবারও না হওয়ার ঘোষণা হয়েছিল। তবে শেষমূহূর্তে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর দিক-নির্দেশনায় এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।
রোববার (১৭ এপ্রিল) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী পরিদর্শনে গেলে জহুর হকার্সের ব্যবসায়ী আজিজ মেয়রের উদ্দেশে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মেলার স্টল বসানো হলে আমাদের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ রমজান মাস আমাদের বেচাবিক্রির মৌসুম। মেয়র মহোদয়কে আমি অনুরোধ জানাব বিষয়টি ভেবে দেখতে।
একইভাবে মেলার আয়োজনের খবর শুনে বেচাকেনার আনন্দ ছাইচাপা পড়েছে দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যর বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মধ্যে। মূলত কোতোয়ালীর টেরীবাজার হয়ে কোরবানিগঞ্জ দিয়ে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন বাজারে পণ্যবাহী গাড়িগুলো প্রবেশ করে। যদিও রমজানকে কেন্দ্র করে তাদের নতুন রুট দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য লোড-আনলোডের জন্য নতুন রুট দেওয়া হলেও এ পথেই বেশি সুবিধা তাদের। তাছাড়া রোজার শেষমুহূর্তে মেলাকে কেন্দ্র করে সড়কে যানজট বৃদ্ধি পেলে ব্যবসায়ে ভাটা পড়বে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ব্যবসা কতটুকু হবে সেটা নিঃসন্দেহে পরিবহনের উপর নির্ভর করে। আর খাতুনগঞ্জ চট্টগ্রামসহ পুরো দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের বাজার। সড়ক বন্ধ করা হলে খাতুনগঞ্জ থেকে পণ্য নিয়ে যেতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা কষ্টে পড়ে যাবেন। রমজান হওয়ায় পণ্য কেনা-বেচায় যে চাপ থাকবে তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এটি যেহেতু ঐতিহ্যের বিষয়, তাই আমরা মেলার আগে-পরে পণ্য কেনা-বেচা বাড়িয়ে একটা ব্যবস্থা নিব। এরপরও খোলা স্থান না রেখে রাস্তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জন্য দুঃখজনক। কারণ তারা সবার কাছ থেকে ছাড় আশা করতে পারে, কিন্তু একটি নগরী গড়তে যা করা প্রয়োজন তা করতে ব্যর্থ।
আন্দরকিল্লার কয়েকজন প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে সড়কে মেলার আয়োজনকে কেন্দ্র করে হতাশার কথা জানান তারাও। প্রিন্টিং প্রেস ব্যবসায়ী উত্তম কুমার বলেন, এবারের রমজানে ইফতার অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সভা-সমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যানারের অর্ডার আসছিল। কিন্তু মেলা শুরু হলে কাজকর্মে ছন্দপতন হবে।
প্রতিবছরের মেলার চিত্র দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে বন্ধ করে দেওয়া হয় লালদীঘি পাড়ের মূল সড়কটি। লালদীঘি পাড় থেকে শুরু করে মেলার স্টল ছড়িয়ে পড়ে সিনেমা প্যালেস মোড়, টেরীবাজার, কাটাপাহাড় লেইন, আন্দরকিল্লা, হাজারী গলি, কোতোয়ালী মোড়, বক্সিরহাট (বদরপাতি জেল রোড) পর্যন্ত। দুই বছর পর মেলার আয়োজনকে কেন্দ্র করে এবারও সেরকম পরিস্থিতি হতে পারে। সাধারণ সময়ে এসব সড়কে দুপুরের পর থেকে রাত পর্যন্ত যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। সেখানে মেলাকে কেন্দ্র করে রমজানের শেষ মুহূর্তে এ সড়কে মারাত্মক যানজট সৃষ্টি হতে পারে।
মাঠ ও স্থায়ী কার্যালয় কোথায়- প্রশ্ন উঠল সভায়
আবদুল জব্বারের বলীখেলা আয়োজনের জন্য নির্দিষ্ট মাঠ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বদরপাতি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা। তাছাড়া আবদুল জব্বারের উত্তরসূরীরা মেয়র রেজাউলের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, বহু বছর ধরে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে বৈশাখী মেলা ও আবদুল জব্বারের বলীখেলার জন্য একটি স্থায়ী অফিস বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ আশ্বাস কবে বাস্তবায়ন হবে? এসময় দ্রুত স্থায়ী কার্যালয়ের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন মেয়র রেজাউল।
রোববারের বৈঠকে মেলা কমিটির সভাপতি ও কাউন্সিলর জহুর লাল হাজারীর উদ্দেশে স্থানীয়রা বলেন, এবার থেকে কি মাঠের বাইরে খেলা হবে। মাঠ না থাকলে হাজারী গলিটা ভেঙে দেন। সেখানে বলী ধরব। এসময় লালদীঘি মাঠের সংস্কার কাজ শেষ হলে আগামী বছর লালদীঘি মাঠেই বলীখেলার আয়োজন করা হবে বলে আশ্বাস দেন জহর লাল হাজারী।
এরআগে লালদীঘি পাড়ে চসিকের লাইব্রেরি ভবনে বৈশাখী মেলা ও আবদুল জব্বারের বলীখেলার মাঠ উদ্বোধন করেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।