চট্টগ্রামের শস্যভান্ডর খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাইবিল। খাদ্য উৎপাদনে এই বিলের তাৎপর্য অপরিসীম। বলা হয়ে থাকে "দেশের আড়াইদিনের খাদ্য উৎপাদিত হয় এই বিলে"। এই জন্য এই বিলকে ধানের গোলা নামেও ডাকা হয়। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা, মরিয়মনগর, হোসনাবাদ, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া, লালানগর ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গুমাই বিলের অবস্থান। গুমাই বিলের জমিতে প্রতিবছরই আমন ও বোরোর বাম্পার ফলন হয়। আমনের বাম্পার ফলনের পর এখন বোরো আবাদের প্রস্তুতি চলছে এই বিলে। বোরোর বীজতলাও পরিপুষ্ট হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে পুরোদমে শুরু হবে বোরো ধান রোপণের কাজ। এরমধ্যে গুমাইয়ের বুকে অবাধে বিচরণ করতে দেখা গেছে নান্দনিক সাদা বক। দিকবিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে বকের দল। ঝাঁকে ঝাঁকে পাল বেঁধে লাঙ্গলের ফলার চার পাশে ঘিরে বসে আছে বক। উঠে আসা মাটির নিচের পোকামাকড় খেয়ে ক্ষুধা মেটাচ্ছে। ঐতিহ্য অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক এই সাদা বক শীতের মৌসুমে রাঙ্গুনিয়ায় গুমাইবিলে ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। পোকামাকড় ও ব্যাঙ খেতে গুমাইবিলে বকের আনাগোনার নয়ানাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন কাপ্তাই সড়কে চলাচলকারী যাত্রীরা। অনেকে আবার গাড়ি থামিয়ে অপরূপ এই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করার চেষ্টা করছেন। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গুমাইবিলে বীজতলা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। কেউ চাষ করছেন, কেউ সেচ দিচ্ছেন, কেউ বীজতলা সমান করছেন, কেউ আইল বাঁধছেন, কেউবা বীজ রোপন করছেন। এরমধ্যে আকাশে সাদা বকের শুভ্রতা ছড়ানোর দৃশ্য সবার নজর কাড়ছে। একটু দূরে যেতেই দেখা যায়, শাহ আলম নামে এক কৃষক জমি চাষ দিচ্ছেন। পিছনে এক ঝাঁক বক শিকারের নেশায় এক পা এক পা এগুচ্ছে। ফসলের মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বকের লুকোচুরি যেন চিরন্তন বাংলার এক নয়নাভিরাম রূপ। হাত নাড়াতেই উড়াল দেয় বকের দল। সারি সারি এসব সাদা বকের ছুটে চলার দৃশ্য গুমাইবিলকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আবার যেসব বিলে রোপন শেষ হয়েছে তাতে পাখির উৎখাত ঠেকাতে কাকতাড়ুয়া রাখা হয়েছে। কিন্তু এতে কোন লাভ হচ্ছেনা। বরং কাকতাড়ুয়ার উপর বসে কিছু একটা শিকার পেতে উৎপেতে আছে বক। এটি যেন তাদের অভয়াশ্রম। তবে বক মূলত ফসলের ক্ষতির চেয়ে উপকারেই বেশি আসে বলে জানান কৃষকেরা। তারা বলেন, চারা ধানের জমিতে কেঁচো, ফড়িং, মাজরা পোকা, পামরি পোকাসহ ফসলের ক্ষতি করে এমন অনেক পোকা দেখা যায়। ক্ষেতে পানি দেওয়ার পর এই সব পোকা ভাসতে থাকে আর তা বক খেয়ে সাবার করে। বক আমাদের প্রাকৃতিক বন্ধু। কাকতাড়ুয়া মূলত বকের জন্য নয়, অন্যান্য পশুপাখি থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য বসানো হয়েছে। স্থানীয় কৃষক মো. শামসুল আলম জানান, এক সময় এখানে সাদা ও কানি বক প্রচুর পরিমাণে দেখা মিলতো। কিন্তু এখন বোরো মৌসুম ছাড়া গ্রামের ঐতিহ্য অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক এই সাদাবক আগের মতো আর দেখা মিলেনা। গাড়ি থেকে ওয়াহিদ নামে এক যাত্রী সাদাবকের ছবি তুলতে নামেন। এসময় তিনি বলেন, ছোট বেলায় অন্যান্য পাখির মতো এই বকের সাথে পরিচিত হয়েছি। কালের বিবর্তনে এসব বক আর তেমন দেখা যায় না। বলতে গেলে এমন দৃশ্য আর চোখে পড়েনা। এদিকে গুমাইবিলের বুইজ্জের দোকান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন লোভী পাখি শিকারী যুবক বক শিকারের জন্য অবৈধ ফাঁদ বসিয়েছে। এই ঘটনা যে শুধু এক জায়গায় ঘটছে তা নয়, গুমাইয়ের একাধিক স্পটে ফাঁদ বসিয়ে বিভিন্ন উপায়ে বক শিকার করা হচ্ছে। মূলত লোভী পাখি শিকারির খপ্পর, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ, গাছগাছালি কেটে নেওয়া সহ প্রভৃতি কারণে দিনদিন গুমাইবিল থেকে আমাদের অতিপরিচিত নান্দনিক এই বক বিপন্নের মুখে পড়েছে। উপজেলা প্রানী সম্পদ কর্মকর্তা মুস্তফা কামাল বলেন, বক সাধারণত উপকারী প্রাণী। তারা ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে থাকে। বিশেষ করে বিল, ডোবায়, ফসলের মাঠে এদের দেখা মেলে। শীতের মৌসুমে অন্যান্য পাখির সাথে এরা আসে। এদের নির্বিঘ্ন বিচরণ নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতাউল গনি ওসমানী বলেন, ফসলের জমির পোকামাকড় খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় নিঃসন্দেহে অবদান রাখছে দৃষ্টিনন্দন বক পাখি। কৃষকদের কীটনাশক সারের ব্যবহার কমাতে হবে। প্রকৃতির সম্পদ এই পাখিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে। এসব পাখি শিকার থেকে দূরে থাকতে হবে। অন্যথায়, অনেক চেনা জানা পাখির মতো বকও একসময় আমাদের সুন্দর বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে।