চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে একের পর এক মারা যাচ্ছে বিপন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলফিন। স্থানীয়ভাবে এসব ডলফিন হুতুম বা শুশুক নামে পরিচিত। বয়সজনিত কারণে মৃত্যু ছাড়াও মানুষের লোভের শিকার হচ্ছে এসব ডলফিন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে ডলফিন হত্যায় মেতে উঠেছে একটি দুষ্টুচক্র। হত্যার পর প্রক্রিয়া করে তেল বের করা হচ্ছে। এ তেল তিন থেকে চার হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মানব সৃষ্ট দূষণের কারণেও মারা পড়ছে নদীর ডলফিন। গত পাঁচ বছরে হালদা নদীতে মারা গেছে ৩৬টি ডলফিন।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) হালদা নদীর শাখা খাল বুড়ি সর্তায় বড় আকৃতির একটি মৃত ডলফিন ভেসে উঠে। ডলফিনটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ৮ ফুট থেকে ৯ ফুটের মতো। ওজন প্রায় ১২০ কেজি। তবে কী কারণে ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে তা জানাতে পারেননি স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে যে ডলফিনের দেখা যায়, তা গাঙ্গেয় প্রজাতির ডলফিন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) গাঙ্গেয় এ ডলফিনকে বিপন্ন হিসেবে লাল তালিকায় রেখেছে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুসারে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘গাঙ্গেয় প্রজাতির ডলফিনের বিচরণ আছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে। দেশের আর কোথাও এ প্রজাতির ডলফিনের দেখা মেলে না। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হালদা নদীতে প্রথম মৃত ডলফিন ভেসে ওঠে। ওই সময় থেকে মৃত ডলফিনের গণনা শুরু হয়। হালদা নদী এবং এ নদীর শাখা খালসহ কর্ণফুলী নদীতে গত পাঁচ বছরে ৩৬টি গাঙ্গেয় প্রজাতির ডলফিন মারা গেছে। এরমধ্যে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে মারা যায় ১৮টি ডলফিন। ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাওয়া যায় ১০টি মৃত ডলফিন। ২০২১ সালে মোট পাওয়া যায় পাঁচটি মৃত ডলফিন। আর ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত হালদায় তিনটি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে।’
এ গবেষক আরও বলেন, এসব ডলফিনের মৃত্যু পেছনে আমরা চারটি কারণ খুঁজে পেয়েছি। আঘাত জনিত কারণে, জালের মধ্যে আটকে শ্বাস বন্ধ হয়ে, চর্বি চুরির জন্য হত্যা ও বয়স জনিত কারণে ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নানারকম আঘাত ডলফিনের মৃত্যুর উল্লেখযোগ্য কারণ। অনেক মৃত ডলফিন উদ্ধারের পর দেখা গেছে শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এগুলো ইঞ্জিনচালিত নৌকার আঘাত। অনেক সময় ভেসে ওঠার সময় দা ও ছুরি দিয়ে ডলফিনগুলোকে আঘাত করা হয়। অনেক জেলে হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরেন। এসব জালে আটকা পড়েও মরছে বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন। এছাড়া চর্বি বিক্রির জন্যও অনেক সময় ডলফিন হত্যা হচ্ছে। ডলফিনের চামড়ার নিচে থাকে চর্বি। কথিত আছে- ডলফিনের চর্বি কবিরাজি ওষুধের পাশাপাশি নানা অসুখের ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার হয়। এ কারণে এক কেজি তেল তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি বয়স হয়ে যাওয়ায় ডলফিনের স্বাভাবিক মৃত্যুও হচ্ছে।
মহিউদ্দিন ইমন নামে মদুনাঘাট এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘এক সময় হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে অনেক ডলফিন খেলা করতে দেখা যেতো। এখন আগের মতো ডলফিনের আনাগোনা নেই। দিন দিন যেন কর্ণফুলী ও হালদা নদী থেকে ডলফিন হারিয়ে যাচ্ছে।’
চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৌপুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর তুলনায় হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখন অনেক বেশি কাজ চলছে। হালদা নদীর জন্য রামদাশ মুন্সিরহাট এলাকায় একটি নৌ পুলিশ ফাঁড়ি করা হয়েছে।
আগামীতে রাউজানে একটি নৌ থানা করার চেষ্টা চলছে। বৃহস্পতিবার যে ডলফিন মারা গেছে সেটি বয়সজনিত কারনে মারা গেছে বলে মনে হচ্ছে। সেটির শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। নৌ পুলিশ হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে নিয়মিত টহল জোরদার রেখেছে।’
রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘হালদায় যে প্রজাতির ডলফিন আছে তা কিন্তু দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। জালের সঙ্গে লেগে সবচেয়ে বেশি ডলফিন মারা যাচ্ছে। বৃহস্পতিবারও একটি ডলফিন মারা গেছে। এটি হয়তো আয়ুষ্কাল শেষ হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছে।’ হালদায় মা মাছ শিকার বন্ধে এবং ডলফিন মারা রোধ করতে নিয়মিত মোবাইলকোর্টের অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। ইতোমধ্যে চিংড়ি পোনা নিয়ে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট আমরা সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছি। ডলফিনসহ মাছের নিরাপদ বাসস্থান গড়তে আমরা সবসময় চেষ্টা চালিয়ে আসছি।