নানা অঘটনে কেটে গেল ইংরেজি বর্ষ-২০২২। পঞ্জিকার পুরনো পাতা শেষ। উদিত হবে নতুন দিনের সূর্য। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যা মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে ২০২২ সাল শুরু। বছরজুড়ে বেশ আলোচিত ছিল ইয়াবা মামলা। রায় হয়েছে আলোচিত ও আত্মস্বীকৃত ১০১ কারবারির। সড়ক দুর্ঘটনা ও একে একে কয়েকটি খুনের ঘটনা বাড়িয়েছে উদ্বেগ। থামছে না রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। নিত্যপণ্যের লাগামহীন বাজারে স্বস্তি নেই কোথাও। বছরের শেষান্তে কক্সবাজার ঘুরে গেলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। তিনি জেলাবাসীকে নতুন কোন ‘উপহার/সুসংবাদ’ না দিলেও সফর ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীরা প্রাণ পায়। ২০২২ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনার কয়েকটি উপস্থাপন করা হলো- সিনহা হত্যা মামলার রায়: সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। দেশের সম্পদ, সারাবিশ্বে অলোচিত নাম। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়ার শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। বিশ্বব্যাপী অলোচিত এই হত্যা মামলার সমস্ত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে মাত্র দেড় বছরের মাথায়। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি রায় ঘোষণা করেন কক্সবাজার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। ঘটনার মাস্টার মাইন্ড টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ ও বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলীর সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। সেই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এ মামলায় বরখাস্ত এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দীনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সাজা দেন বিচারক। সিনহা হত্যা মামলার রায়টি ছিল বিচারকের সাহসিকতা ও যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফসল। যার কারণে বিচার বিভাগও প্রশংসিত হয়েছে। আত্মস্বীকৃত ১০১ ইয়াবা কারবারির কারাদণ্ড: ইয়াবার স্বর্গরাজ্য সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ। কঠোর আইন ও শক্তি প্রয়োগেও থামছে না মাদকের ছড়াছড়ি। রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা নিয়ন্ত্রণ করেন এই ব্যবসা। সরকারের কঠোরতা ও আশ্বাসের বানীতে আশ্বস্ত হয়ে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি। মাদক ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুই মামলায় তাদের পাঠানো হয় কারাগারে। সেখানে মারা যান একজন। বাকী আসামিদের রায় আসে ২৩ নভেম্বর। রায়ে প্রত্যেককে দেড় বছর করে কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা প্রদান করেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। মামলাটি ছিল টক অব দ্যা কান্ট্রি। তবে, প্রায় আসামি বর্তমানে জামিনে মুক্ত। জেলা পরিষদে মোস্তাক মিয়ার হার, মার্শালের জয়: রাজনীতিতে অনেকটা ‘অপরাজিত’ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত খান বাহাদুর মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। গেল পরিষদের চেয়ারম্যান। এক সময় এমপিও ছিলেন। এবারও লড়েন নৌকা প্রতীকে। তাকে জেতাতে দলীয় নেতারা কম চেষ্টা করেনি। মাঠে অনেক ‘জলঘোলা’ হয়। না, তবু পেরে ওঠেনি। ১৭ অক্টোবর মোস্তাক মিয়াকে পরাভুত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী শাহীনুল হক মার্শাল। ছেলের বয়সী প্রার্থীর হাতে ধরাশায়ী মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। এমনকি নিজের এলাকাতেও সন্তুষজনক ভোট পাননি তিনি। যেটি রাজনীতির মাঠে বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। শাহীনুল হক মার্শাল সৃষ্টি করলেন নতৃন দৃষ্টান্ত। জেলা পরিষদ পেল তরুণ, যোগ্য নেতৃত্ব। ক্ষোভ আর দ্রোহের আগুনে পুড়লো মোস্তাক মিয়া। ফয়সাল হত্যা মামলায় ৪ আসামির মৃত্যুদণ্ড: কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ৫ম সেমিস্টারের ছাত্র জিয়া উদ্দিন ফয়সাল হত্যাকাণ্ডে চার আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। তারা হলেন, সদরের পিএমখালীর পূর্ব মাছুয়াখালীর নুরুচ্ছফার ছেলে রেজাউল করিম প্রকাশ বুইল্লানির ছেলে (২০), মৃত আমান উল্লাহর ছেলে নুরুল হক (২৩), মৃত অছিয়র রহমানের ছেলে রমজান আলী (২৫) ও মো. ইসহাকের ছেলে রুবেল (২৩)। ৩১ আগস্ট এসটি ১২৮/১৮ শুনানি শেষে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এই রায় প্রদান করেন। মামলার দুই আসামি একই এলাকার আবছারের ছেলে শাহিন উদ্দিন (২৩) ও দুদু মিয়ার ছেলে মনি আলম (১৯)কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারক। সেই সঙ্গে তাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ইয়াবা বিক্রিতে বাধা দেওয়ায় ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল রাতে নিজ গ্রামে মাছুয়াখালী জামে মসজিদের সামনে জিয়া উদ্দিন ফয়সালকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে মাদক কারবারিরা। ঘটনার পরদিন ১৭ এপ্রিল ৯ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন পিতা মো. নুরুল আনোয়ার। মোরশেদ বলি হত্যা: গত ৭ এপ্রিল ইফতারের আগ মুহূর্তে কক্সবাজার সদরের বিএমখালীতে মোরশেদ আলি প্রকাশ বলি মোরশেদে জনসম্মুখে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তাকে ‘ওপরের নির্দেশে’ হত্যা করা হয়েছে বলে প্রচার পায়। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ-যুব লীগের ১০ নেতাসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে গত ৯ এপ্রিল কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন নিহতের ভাই জাহেদ আলি। যার মামলা নং- ১৭/২২৭। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরো ১০ জন আসামি রয়েছে। নিহত মোরশেদ আলি পিএমখালী মাইজপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মরহুম ওমর আলীর পুত্র। ঘুষের টাকাসহ সার্ভেয়ার আটক: ঘুষের ২৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯০০ টাকাসহ ১ জুলাই ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক হন কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার (এলএও) সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান। পরে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় তাকে ৫ দিনের রিমান্ড দেয় আদালত। সার্ভেয়ার আতিকের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। মহেশখালীতে সরকারের প্রায় ১৫টি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। একজন ভূমি কর্মকর্তা বিপুল পরিমাণ টাকাসহ ধরা পড়ার ঘটনায় সারাজেলায় তোলপাড় হয়। নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল হত্যা:
৩ জুলাই সন্ধ্যায় দলীয় সম্মেলন থেকে ফেরার পথে কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলের ডেইলপাড়ায় পুলিশের সামনেই সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পর ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। সড়ক অবরোধ, ভাঙচুর, বিক্ষোভ সমাবেশ করে দলের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নিহত ফয়সাল উদ্দিন ইউনিয়নের কাউয়ারপাড়া এলাকার লাল মোহাম্মদের ছেলে। তিনি অত্যন্ত ভদ্র ও শান্তশিষ্ট ছেলে হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ঘটনাটিকে ‘পরিকল্পিত’ বলে দাবি পরিবারের। ছাত্রলীগ নেতা ইমন হত্যা: চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন কক্সবাজার শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমন হাসান মওলা (২০)। ২১ জুলাই দিবাগত রাত ৩টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিহত ইমন শহরের উত্তর টেকপাড়ার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাছানের পুত্র। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ করে দলীয় নেতা কর্মীরা। হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর ১৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহত ইমনের বাবা মো. হাসান। মামলার কয়েকজন আসামি গ্রেফতার হয়ে কারান্তরীণ ছিলেন। শিশু আলো হত্যা মামলার রায়: টেকনাফ উপজেলা বিএনপি নেতা মো. আবদুল্লাহর ছেলে আলী উল্লাহ আলো হত্যা মামলায় ১১ মে ৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। আসামিরা হলেন, নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার খোদ্দ নারায়ণপুর গ্রামের মো. আফতাব আলী প্রকাশ আতাব আলীর ছেলে মো. সুমন মিয়া (পলাতক), ঠাকুরগাঁও জেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের মৃত শামছুল হকের ছেলে ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান (হাজতে), কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের আসলাম মিয়ার ছেলে মো. ইয়াকুব (হাজতে), কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার গোদারবিল গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে মো. ইছহাক প্রকাশ কালু (হাজতে), একই উপজেলার মহেশখালীয়া গ্রামের মৃত নবী হোসেনের ছেলে নজরুল ইসলাম (পলাতক), মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু উপজেলার ধুনচিপাড়া গ্রামের মৃত আবদুর রহিমের ছেলে সৈয়দুল আমিন প্রকাশ লম্বাইয়া (পলাতক)। ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আলী উল্লাহ আলো খুনের শিকার হন। ঘটনাটি তখনকার সময় বেশ অলোচিত হয়। বর্ধিত সভায় দলীয় নেতাদের পেটালেন সাবেক এমপি বদি: কক্সবাজারের টেকনাফে দলীয় বর্ধিত সভায় বক্তব্যের বিরোধিতা করায় পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিসহ কয়েকজন নেতাকে পিটিয়েছেন বিতর্কিত সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। ২২ এপ্রিল সন্ধ্যায় উপজেলা হল রুমে টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা চলাকালে এ হামলার ঘটনাটি দলের ভেতরে-বাইরে প্রচুর সমালোচনার ঝড় তুলে। পিক-আপের ধাক্কায় ৫ সহোদর নিহত: দশদিন আগে মারা যাওয়া বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে পিক-আপের ধাক্কায় ৫ সহোদর নিহত হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টার দিকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়ায় উপজেলার মালুমঘাট বাজার সংলগ্ন নার্সারি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে নিহতরা হলেন, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড হাসিনা পাড়া এলাকার মৃত সুরেশ চন্দ্র শীলের ছেলে ডা. অনুপম শীল (৪৬), তার ভাই নিরুপম শীল (৪০), দীপক শীল (৩৫), চম্পক শীল (৩০)। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে রক্তিম শীল (৩৬) নামের আরও এক ভাই মারা যান। দুর্ঘটনায় আহত হন, সরন শীল, প্লাবন ও হীরা শীল। একই পরিবারের ৫ সদস্য নিহতের ঘটনা সবার হৃদয়ে দাগ কাটে। স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে এই সংবাদ প্রচার পায়। প্রধানমন্ত্রীর সফর: আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদের শেষান্তে ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজার অগমন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন সকালে তিনি ইনানীর পাটুয়ারটেকস্থ বঙ্গোপসাগরে সেনা বাহিনী আয়োজিত আন্তর্জাতিক নৌশক্তি প্রদর্শন ও জেটি উদ্বোধন করেন। বিকালে কক্সবাজার সাগর পাড় সংলগ্ন শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগের সমাবেশে বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২৯ টি প্রকল্প উদ্বোধন ও ৪ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। তবে, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ কক্সবাজারবাসীর ১১ দাবির কোনটিই প্রধানমন্ত্রীর নিকট গুরুত্ব পায়নি। আশার বাণীও শোনা যায় নি।