একক প্রকল্প হিসাবে দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ প্রকল্পে মোট খরচ ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। যার ৯০ শতাংশই রাশিয়ার ঋণ সহায়তা। দেশটির ভিবি ব্যাংক এ ঋণ দিচ্ছে। এ প্রকল্পে সরকারের অর্থায়ন মাত্র ১০ শতাংশ। অর্থাৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট ব্যয়ের ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকাই দিচ্ছে রাশিয়া। সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হচ্ছে বাকি ২২ হাজার ৫২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে মোট খরচ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে পদ্মার সেতুর চেয়ে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে তিনগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। তবে রূপপুরের টাকা ঋণনির্ভর। আর পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর চেয়ে দেশে একাধিক মেগা প্রকল্পের ব্যয় বেশি। যেমন- পদ্মা সেতু রেললিঙ্ক প্রকল্প। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা, যার ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা চীনের দেওয়া ঋণ। মহেশখালী–মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়নপ্রকল্পও পদ্মা সেতু প্রকল্পের চেয়ে বড়। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে জাপানি ঋণ ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। বাকি ছয় হাজার ৪০৬ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে থেকে মেটানো হবে।
ঢাকায় পাতাল রেল নির্মাণের কাজ চলমান। এ প্রকল্পের ব্যয়ও পদ্মা সেতুর চেয়ে বেশি। কয়েক দফা জরিপ ও ফিজিবিলিটি স্টাডির পর নির্ধারণ করা হয়েছে আরেক মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-১-এর রুট। এর আওতায় এয়ারপোর্ট থেকে কমলাপুর আর নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ২৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করা হয়। এমআরটি লাইন-১-এ এয়ারপোর্ট-খিলক্ষেত-যমুনা ফিউচার পার্ক-নতুনবাজার-বারিধারা-উত্তর বাড্ডা-হাতিরঝিল-রামপুরা-মৌচাক হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২ কিলোমিটার আর অন্যটি নতুনবাজার-যমুনা ফিউচার পার্ক-বসুন্ধরা-পুলিশ অফিসার হাউজিং সোসাইটি-মাস্তুল-পূর্বাচল পশ্চিম-পূর্বাচল সেন্টার-পূর্বাচল সেক্টর-৭-পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩ কিলোমিটার রুট নির্মিত হবে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক ঋণে সুদ দিতে হবে এক হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে পরামর্শক খাতে পাঁচ কোটি ও প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় সেমিনার, কর্মশালা ও সম্মেলনে দেড় কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ৫১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাইকার দেওয়া ঋণ ৩৩ হাজার ৯১৪ কোটি ১১ লাখ টাকা।
অর্থাৎ এটা বলা যায়, পদ্মা সেতুর থেকে ব্যয়বহুল একাধিক প্রকল্প হচ্ছে। তবে দেশীয় টাকায় পদ্মা সেতুই সেরা। কারণ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার সবই দেশীয় অর্থায়ন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। এরপর একে একে সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে।
বিশ্বব্যাংকসহ অন্যরা অর্থায়ন স্থগিতের পর প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসে মালয়েশিয়ার সরকার। এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলার পর তা আর এগোয়নি। ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় সরকার।
অবশ্য ২০১৪ সালে তদন্ত শেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়ে দেয়, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে কানাডার টরন্টোর এক আদালতও জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ পাননি তারা। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক চলে যাওয়ার পরে দেশীয় টাকায় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন কৃতিত্ব দেখায় বাংলাদেশ।
পদ্মা সেতু থেকে মাসে টোল আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বছরের হিসেবে তা হবে এক হাজার ৬০৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ টাকা দিয়ে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও নির্মাণ খরচের ঋণ পরিশোধ করবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। কোনো উন্নয়ন সহযোগী বা প্রতিষ্ঠানকে নয়, স্বয়ং বাংলাদেশ সরকারকে ৩৫ বছরে সুদসহ ৩৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মিত। এর পুরোটাই সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। চুক্তির অনুচ্ছেদ-২ মোতাবেক ঋণের অর্থ প্রকল্প সমাপ্তির পর বার্ষিক ১ শতাংশ হারে সুদসহ ৩৫ বছরে ১৪০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া নকশা প্রণয়নের সময় নেওয়া ২১১ কোটি টাকার বিপরীতে ৩৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পদ্মা সেতু বাঙালি জাতির বড় অর্জন। নিজেদের টাকায় এত বড় অর্জন দ্বিতীয়টি নেই। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বাঙালি জাতির জন্য পদ্মা সেতু গৌরব ও অহংকারের। তবে কারও কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়নি। এটা আমাদের টিম লিডার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে গোটা জাতি এ টাকা দিয়েছে।