সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঁচ বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পাওনা প্রায় ৪৬৮ কোটি টাকার ভ্যাট।
এনবিআর বলছিল, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত আদায়কৃত মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ফাঁকি দিয়েছে ।
বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) বলেছিল, এনবিআরের নির্দেশনা বহির্ভূত সময়কালের ওই ভ্যাট আদায় হয়নি। তাই পরিশোধের প্রশ্নই আসে না। সে কারণেই এনবিআরের দাবি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
অবশেষে সেই দাবি থেকে সরে এলো চবক। গত জুলাই থেকে চিঠি চালাচালি ও দফায় দফায় দুই পক্ষের বৈঠক হয়েছে। এতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা হয়নি, তাদের শনাক্ত করে ভ্যাট আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ সিদ্ধান্তের পরপরই চবক নতুন উদ্যোগ নেয় এবং এনবিআরকে জানায়। বকেয়া ভ্যাট আদায়ের উদ্যোগের কথা জানিয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইস ও ভ্যাট কমিশনারকে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (অর্থ) ও যুগ্ম সচিব মো. কামরুল আমিনের সই করা চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। চিঠির কপি কাছে সংরক্ষিত আছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ-বছরে সেবা গ্রহণকারী হিসেবে শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরওয়ার্ডদের তথ্য সংগ্রহের জন্য ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চবকের একাধিক বিভাগ থেকে বন্দর ব্যবহারকারীদের সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। কার্গো বা কনটেইনার খাতে সেবা গ্রহণকারী হিসেবে শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও ব্রেইট ফরওয়ার্ডদের তথ্য পাঠানোর জন্য চবকের পরিবহন বিভাগে চিঠি পাঠানো হবে । জাহাজ খাতে সেবা গ্রহণকারী হিসেবে শিপিং এজেন্টদের তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বছরভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের পর এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনবিআর সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে ৬৯ ধরনের সেবা দেওয়া হয়, যার বিপরীতে ৫, ৯ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে এতে সেবার বিপরীতে যে ভ্যাট আদায় হয়, তা সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয় না বলে বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ পায় এনবিআর।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি নিরীক্ষা দল গঠন করে মূসক গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদান, দাখিলপত্র ও ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিল দিতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু কাগজপত্র দেয়। পরে চাহিদামতো আরও কাগজপত্র যেমন- বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন, ভ্যাট সংক্রান্ত দলিল, দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) প্রভৃতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করে মূসক গোয়েন্দা।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ১৯৯১ ও একই আইনের বিধিমালা অনুযায়ী মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি (মূসক চালান-১১, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, দাখিলপত্র) সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সেবা দেওয়ার বিপরীতে বিক্রয় হিসাব পুস্তক সংরক্ষণ করেনি, যা মূসক আইনের ধারা ৩১ ও বিধি ২২ লঙ্ঘন।
এসব বিষয় উল্লেখ করে গত ১৪ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে বকেয়া ৪৬৭ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ৮১৬ টাকা ভ্যাট ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে পরিশোধের অনুরোধ করে এনবিআর। এর কিছুদিন পর বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ ও বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) লক করে বকেয়া ভ্যাট আদায় করার কথা উল্লেখ করে আবারও চিঠি দেয় ভ্যাট অফিস।
কিন্তু গত ২১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট বরাবর পাঠানো চিঠিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলে- এনবিআর যে সময়ের ভ্যাটের কথা বলছে, তখন ভ্যাট বিভাগের কোনো নির্দেশনা ছিল না। ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে কোনো ভ্যাট সংগ্রহ করেনি। তাই ভ্যাট বিভাগ যে ভ্যাট দাবি করছে তা অযৌক্তিক।
তাই এনবিআরের দাবি প্রত্যাহারের চিঠি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলে, ১৯৮৬ সাল থেকে বিভিন্ন সেবার বিপরীতে কোনো ভ্যাট অন্তর্ভুক্তি ছাড়াই ৬০টি ট্যারিফ আইটেম প্রচলন করা হয়েছিল। এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে মাশুলের ওপর পণ্যাগার হিসেবে এবং পরে একইরূপ বর্ণনাপূর্বক ২০০৮ সালে ‘বন্দর’ হিসেবে ভ্যাট আরোপ করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রচলিত ট্যারিফের ৬০টি আইটেমের মধ্যে দুই ধাপে অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে ২১টি ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০৪ সালে চারটি আইটেমসহ মোট ২৫টি আইটেমের ওপর ভ্যাট আদায়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনা অনুসরণ করে চট্টগ্রাম বন্দর সরকারি কোষাগারে মূসক পরিশোধ অব্যাহত রাখে।
২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বরের নির্দেশনা দেওয়ার পর সব আইটেমের ওপর ভ্যাট আদায় করা হয়। ভ্যাট প্রবর্তিত হওয়ার পর সেবা গ্রহণকারী অর্থাৎ বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে যথারীতি জমা করা হয়েছে। ওই সময়ে ভ্যাট কর্তৃপক্ষ কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেনি। অথচ সম্প্রতি এক চিঠিতে বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ ও বিআইএন লক করার কথা বলা হয়েছে।
দেশের আমদানি-রপ্তানির শতকরা ৯২ ভাগ যে বন্দরের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়, সে সংস্থার ক্ষেত্রে এরূপ বক্তব্য অনভিপ্রেত বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, এনবিআরের দাবিকৃত বকেয়া ভ্যাট বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আদায়কৃত সেবা মূল্যের ওপর নিরূপিত নয়, বিধায় ওই দাবি যথাযথ নয়। কারণ, শতভাগ রপ্তানিমুখি অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান এনবিআর থেকে ট্যারিফ আইটেমের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি পেয়ে থাকে। ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় না নিয়ে ২০১৫-২০১৬ থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ট্যারিফ আইটেমগুলোকে ভিত্তি ধরে আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
তাছাড়া বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের কাছে প্রায় ৬০ কোটি, চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেডের কাছে ১০ কোটি ও লোকাল ভেসেল বিল বাবদ প্রায় ১৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন শিপিং এজেন্টের জরিমানা ও কোটি কোটি টাকা বন্দর মাশুল বকেয়া, যা ভ্যাট কর্তৃপক্ষের বকেয়া ভ্যাট দাবিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই এভাবে একতরফাভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আদায়কৃত সেবা মূল্যকে বিবেচনা না করে অনাদায়ী আয়ের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাট হিসাব করা অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন ।
সর্বোচ্চ ভ্যাটের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকে সম্মাননা স্মারক দেওয়ার কথা উল্লেখ করে কর্তৃপক্ষ চিঠিতে আরও বলে, কোভিড-১৯ মহামারিকালেও চট্টগ্রাম বন্দর সচল রেখে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানসহ আয়কর ও ভ্যাট আদায়ে সচেষ্ট ছিল এনবিআর। সীমিত জনবল দিয়ে ভ্যাট আদায়ের মতো জটিল কার্যক্রম ইতিবাচক হিসেবে দেখার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ এনবিআরের সহযোগিতা চায়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম ভ্যাট অফিস থেকে যে ভ্যাট দাবি করা হয়েছে, তা এখনো বকেয়া রয়েছে। যখন এনবিআরের ভ্যাট সংগ্রহের আদেশ জারি করা হয়, তারপর থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করেছি। সরকারি কোষাগারে তা জমাও দেওয়া হয়েছে। আদেশের আগে ভ্যাট সংগ্রহের প্রশ্ন ছিল না।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ভ্যাট কমিশনারও আমাদের অফিসে এসেছিলেন। আমাদের চেয়ারম্যানসহ মিটিং করেছি। সেখানে আমরা বলেছি, আদেশের আগে যেহেতু সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ভ্যাট নেওয়া হয়নি, তাই জমা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। অফিস আদেশের পর থেকে নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধ করা হচ্ছে। এখন সরকারি পর্যায়ে যে সিদ্ধান্ত আসবে, আমরা সেটিই বাস্তবায়ন করব।
অন্যদিকে এনবিআর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।