১৯৮৫ সালে ৩৩ বছর বয়সের যুবক আবদুল মোনাফ ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে অবৈধ পথে গিয়েছিলেন পাকিস্তান। কিন্তু ভাগ্যের চাকা তো ঘোরেইনি উল্টো জীবনের সোনালী সময় তীলে তীলে হারিয়ে শেষমেষ ৭০ বছর বয়সে দেশে পরিবারের কাছে ফিরেছেন আবদুল মোনাফ।
মাঝখানে আবদুল মোনাফের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ৩৭টি বছর। এ দীর্ঘ বছর পরিবার থেকে দুরে পাকিস্তান সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে যুক্ত থাকলেও সিংহভাগ সময় কেটেছে জেলে বন্দি অবস্থায়। রেড ক্রিসেন্টের সহযোগিতায় গত ২৯ জুন খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার যোগ্যছলা ইউনিয়নের যোগ্যছলা নিজ বাড়িতে ফিরেছেন। দীর্ঘ বছর পর পরিবার পেয়ে আত্মহারা পরিবারের সবাই। এদিকে আবদুল মোনাফের ফেরার খবরে তাকে দেখতে ছুটে আসছেন গ্রামের লোকজন।
জানা যায়, ১৯৮৫ সালে নোয়াখালীর এক দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে পাকিস্তান পাড়ি জমান আবদুল মোনাফ। সে সময় এলাকার আরও সাতজনসহ মোট ৭৫ জন বাংলাদেশি কাজের সন্ধানে করাচি যান। আবদুল মোনাফ সেখানারকার সমুদ্রে মাছ ধরতেন। সেখানে আট/নয় বছর পর মাছ ধরতে গিয়ে সোমালিয়া সীমান্তে ঢুকে যাওয়ায় সে দেশের পুলিশ তাদের আটক করে। প্রায় তিন মাস জেল খেটে পাকিস্তানে হস্তান্তর করা হলে সেখানে দেড় বছর জেল খেটে বের হন।
ঘটনার কয়েক বছর পর আবার মাছ ধরতে গিয়ে সোমালিয়ায় আটক হলে ফের করাচিতে পাঁচ বছর জেল খাটেন। বের হয়ে আবার মাছ ধরা শুরু করেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় না হওয়ায় এবার আটক হয়ে জেল খাটেন তিন বছর।
দীর্ঘশ্বাস নিতে নিতে উক্ত প্রতিবেদককে আবদুল মোনাফ বলেন, ততদিনে আমি প্রায় ১০ বছর জেল খেটে ফেলেছি। জীবনে আর কোনো আশা ছিল না। শুধু দেশে ফিরতে পারলেই হতো। প্রায় দুই বছর ধরে পাকিস্তানে অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করি। কিন্তু লাভ হয়নি। পরে ভাবলাম সীমান্তে গেলে কাগজ দেখালে হয় তো ইন্ডিয়া পার হতে পারব, সেখান থেকে বাংলাদেশ। কিন্তু সীমান্ত থেকে আমাকে আটক করে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে জেলে থাকা অবস্থায় পাকিস্তান রেডক্রিসেন্ট আবদুল মোনাফ সম্পর্কে জেনে তাকে দেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশের রেড ক্রিসেন্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রায় পাঁচ মাসের চেষ্টায় আবদুল মোনাফকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফেরত পাঠান।
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির পারিবারিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এস এম জাহিদুর রহমান বলেন, পাকিস্তান রেডক্রিসেন্ট থেকে আবদুল মোনাফের তথ্য পেয়ে আমরা কাজ শুরু করি। দুই দেশের অ্যাম্বাসি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ শেষে আমরা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে আবদুল মোনাফকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।
এদিকে দীর্ঘ বছর পাকিস্তানে থাকায় ভালো করে বাংলা বলতে না পারা আবদুল মোনাফ ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দু ও বাংলার মিশেলে বলেন, জীবনের সবটুকু হারিয়েছি। এখন বৃদ্ধ বয়সে যে কদিন বাঁচবো স্ত্রী-সন্তান দেখে মরতে পারব আর নিজ দেশের মাটিতে মরতে পারব, এতটুকুই আমার শান্তি।
আবদুল মোনাফের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়েছে। ছেলে দেশের বাইরে চাকরি করে। স্ত্রী খাতিজা বেগম বলেন, ওনাকে (আবদুল মোনাফ) যে ফিরে পাব, সেই আশা অনেক আগে ছেড়ে দিয়েছিলাম। স্বামীকে ফেরত নিয়ে আসবে বলে অনেকে আমার কাছ থেকে টাকাও নিয়েছে। এখন ফিরে পেয়ে আমার আর কোনো চাওয়া নেই। যারা আমার স্বামীকে ফেরত আনতে সহযোগিতা করছেন, সবার জন্য আমি দোয়া করি।
৩৭ বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু। আবদুল মোনাফের এ জীবন শুধু পরিবারের সঙ্গে পুরাতন দুঃখ রোমন্থন করে হারানো সংসার জীবনের গল্প শুনতে শুনতেই কেটে যাবে। জীবনের তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করা আবদুল মোনাফের তাই অনুরোধ, ভুল পথে যেন কেউ বিদেশ না যায়।