বাংলাদেশের রেলওয়ে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ লাইনে বিভক্ত। ফলে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের খুলনা ও রাজশাহীর সরাসরি রেলযোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।
পুরো দেশকে রেল সংযোগের মাধ্যমে আনতে এরইমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবললাইন ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ব্রডগেজ লাইন স্থাপন হলে পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও খুলনার সঙ্গে চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। পশ্চিমাঞ্চলে ব্রডগেজ রেল ঢাকা পর্যন্ত থাকলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরো রুট এখনও মিটারগেজেই রয়ে গেছে।
রেলওয়ে মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের রূপান্তরের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু যথাসময়ে বৈদেশিক ঋণের অভাবে প্রকল্পটি সময়মতো শুরু করা যায়নি।
এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) থেকে অর্থায়নের প্রাথমিক নিশ্চিয়তা পাওয়ার পর রেলওয়ের আশার সৃষ্টি হয়েছে।এজন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে সময়সীমা ২ বছর পিছিয়ে ২০২৭ সালের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের পুরো মিটারগেজ রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তরের কাজ শেষ করা সম্ভব বলে মনে করছে।প্রকল্পের আওতায় লাকসাম থেকে চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তর করা হবে। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে আনুমানিক মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ২০৭ কোটি টাকা।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকা–চট্টগ্রাম রুটে রেলের গতি বাড়বে এবং ৩০ শতাংশ বেশি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হবে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় কমবে প্রায় এক ঘণ্টা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বলেন, রেলওয়ের মহাপরিকল্পনায় সারা দেশে পর্যায়েক্রমে রেল নেটওয়ার্ক ব্রডগেজে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল রুটের রূপান্তরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
একটি প্রকল্পের আওতায় আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কাজ শেষ পর্যায়ের রয়েছে। কয়েক বছর আগে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও বৈদেশিক ঋণ না পাওয়ায় টঙ্গী-আখাউড়া এবং লাকসাম–চট্টগ্রাম অংশের কাজ শুরু করা যায়নি। এডিবির সঙ্গে সময়মতো ঋণ চুক্তি এবং নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে আশা করা যাচ্ছে ২০২৭ সালের মধ্যে পুরো ঢাকা-চট্টগ্রাম ডুয়েলগেজে রূপান্তর হবে, যোগ করেন তিনি।
সম্প্রতি এডিবি ২০২৩ সালে লাকসাম-চট্টগ্রাম ডুয়েলগেজ প্রকল্পের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে টঙ্গী-আখাউড়া ডুয়েলগেজ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দানের আশ্বাস দিয়েছে। প্রকল্পগুলোর জন্য পরে সংস্থাটি আরও ঋণ অনুমোদন দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী, টঙ্গী থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৯৩ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনে রূপান্তর করতে ব্যয় হবে ১৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। ব্যয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।অন্যদিকে, লাকসাম-চট্টগ্রাম রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তর করতে খরচ ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যার ৮৫ শতাংশ বিদেশি ঋণদাতাদের কাছ থেকে ধার নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সূত্র জানায়, এডিবির আর্থিক সহায়তায় একটি প্রকল্পের আওতায় টঙ্গী-আখাউড়া ও লাকসাম-চট্টগ্রাম রেললাইন রূপান্তরের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।প্রকল্প পরিচালক শহিদুল ইসলাম জানান, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের ৮৪.৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এডিবি এই প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ৬ হাজার ৫০৪.৫৪ কোটি টাকা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলরুটের অন্তর্ভুক্ত আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত একটি ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। প্রকল্পের অধীনে ৭২ কিলোমিটার রেললাইন ব্রডগেজে রূপান্তরিত হবে। তবে মূল নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। গত বছর সেপ্টেম্বরে এর একটি অংশ চালু করা হয়েছে।যদিও ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) বাধায় প্রকল্পটির দুটি স্থানে কাজ বন্ধ রয়েছে প্রায় দেড় বছর ধরে। এতে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি রেলভবনে অনুষ্ঠিত প্রকল্পটির প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, গত বছর বিএসএফ প্রকল্পটির সালদা নদী ও কসবা স্টেশন এলাকায় কাজ বন্ধ করে দেয়। তবে নানা উদ্যোগ নিলেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি। ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বিষয়টি জানানো হলেও কোনো লাভ হয়নি। পরে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। এর পরও কাজ শুরু না হওয়ায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। এতে ক্ষতিপূরণ চাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বৈঠকে জানানো হয়, প্রকল্পটির সালদা নদী স্টেশনের নিকটবর্তী নির্মাণাধীন ডাউন ২৬১নং সেতুর কাজ বিএসএফ প্রথমবার বন্ধ করে দেয় গত বছর ২৫ মার্চ। ৩১ মার্চ বিষয়টি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে সুরাহা করতে বলা হয়। সে সময় ৭ এপ্রিল পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখা হয়। এরপর ওই সেতুর কাজ শুরু হলে ১০ জুন আবার তা বন্ধ করে দেয় বিএসএফ। এরপর প্রায় সাত মাস কাজ বন্ধ থাকে।
ভারতীয় হাইকমিশনারকে গত বছর ২৪ জুন বিষয়টি অবহিত করা হয়। ২ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি সুরাহা করতে আবারও চিঠি দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। এছাড়া ১১ অক্টোবর প্রকল্পে ঋণদানকারী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি) বিষয়টি জানানো হয়। সেবার ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখতে হয়।
গত ১ জানুয়ারি বিজিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লে. কর্নেল মেহেদির সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনাক্রমে সালদা নদী স্টেশনের নিকটবর্তী ২৬১নং ডাউন সেতুর কাজ শুরু করা হয়। তবে ১৩ জানুয়ারি আবারও এ কাজ বন্ধ করে দেয় বিএসএফ।
পরে ২৬ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বিষয়টি জানানো হয়। তবে কাজ আর শুরু করা যায়নি। অপরদিকে বিএসএফের বাধায় কসবা স্টেশনের কাজ গত বছর মার্চ থেকেই বন্ধ। সেটা আর শুরুই করা যায়নি। ফলে সার্বিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হচ্ছে।
জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে হওয়ায় এ কাজে বাধা দিয়েছে বিএসএফ। তারা জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। এর আগে ভারতেও সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে রাস্তা নির্মাণ করতে গেলে বাধা দিয়েছিল বিজিবি। এখন তারা বাধা দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানালেও কাজ হচ্ছে না।