আজ রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণ: সপ্তাহ পেরোলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে ধোঁয়াশা

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : রবিবার ১২ জুন ২০২২ ০৯:৩৬:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

#আগুনে কার কী পরিমাণ ক্ষতি, তথ্য নেই কারও হাতেই

#আরও সময় চায় বিভাগীয় কমিশনের তদন্ত কমিটি

#বিজিএমইএ তালিকা করলেও এখনো ক্ষয়ক্ষতির তালিকা নেই

বিকেএমইএর, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশন, বিকডা

#সীতাকুণ্ড থানায় ১৫ জিডি

#টাকার অংকে ক্ষতি জানালেও পণ্যের পরিমাণ বলছে না শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো

 

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের সপ্তাহ পেরোলেও এখনো ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা। যদিও সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, স্মরণকালের ভয়াবহ এ আগুনে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে অগ্নিকাণ্ডের দিন ডিপোতে কোন প্রতিষ্ঠানের কী পরিমাণ পণ্য ছিল, টাকার অংকে সেসব পণ্যের দাম কত, তা নিয়েও কোনো তথ্যতালিকা সামনে আসেনি। বিশেষত, তৈরি পোশাক খাতের কী পরিমাণ রপ্তানিপণ্য ডিপোতে ছিল তা-ও জানা যায়নি।

 

ডিপোর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই পোশাকশিল্প সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠনের হাতে। যদিও দেশের পোশাক ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বলছে, ডিপোর আগুনে ১৮১ প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪৩৬ কোটি টাকার পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক পোশাকশিল্প মালিক এরই মধ্যে সীতাকুণ্ড মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন।

রোববার (১২ জুন) সীতাকুণ্ড মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বলেন, বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ প্রতিষ্ঠান থানায় জিডি করেছে। তবে জিডিতে এসব প্রতিষ্ঠানের কার কী পরিমাণ পণ্য পুড়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করেছে। এসব জিডির ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। বন্দর, কাস্টম, ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষও অগ্নিকাণ্ডের পরপরই পৃথকভাবে তদন্তে নামে।

সীতাকুণ্ড মডেল থানা সূত্রে জানা গেছে, জিডিতে মেট্রো নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ ডলার। এপেক্স লিংগারী লিমিটেড ক্ষতির পরিমাণ দেখিয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৬৮ ডলার। ক্লিফটন গ্রুপ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ না করলেও প্রতিষ্ঠানটি পৃথক জিডিতে ২৪ হাজার ৯৪৪ ডজন ও ৬ হাজার ৪৩৫ ডজন তৈরি পোশাক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে। জিডিতে এপেক্স টেক্সটাইলের ৪২ হাজার ৪১১ দশমিক ৮৯ মার্কিন ডলার এবং অ্যাপারেলস গ্যালারি লিমিটেড ক্ষতি দেখিয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ১৯৮ ডলার।

এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী রোববার সকালে বলেন, বিএম ডিপোর আগুনে কোন প্রতিষ্ঠানের কী পরিমাণ পণ্য ছিল, সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানাতে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে সার্কুলার জারি হয়েছিল। এরই মধ্যে ১৪১টি প্রতিষ্ঠান তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানিয়েছে। যেখানে মোট ৪৭ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৩৬ কোটি টাকার বেশি) মূল্যের পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি প্রতিষ্ঠান মালিকদের।

যদিও পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। কারণ, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডরা (আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা ও আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন) কী পরিমাণ পণ্য রিসিভ ও জাহাজীকরণ করেছে, সে তথ্য মেলানোর পর চূড়ান্ত ক্ষতি নির্ধারণ সম্ভব হবে। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যে দাবি করছে, পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তা কম-বেশি হতে পারে।

তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডে অক্ষত পণ্যগুলোর দ্রুত জাহাজীকরণ প্রয়োজন। বিএম ডিপো থেকে পণ্যগুলো অন্য ইয়ার্ডে নিয়ে জাহাজীকরণের ব্যবস্থার জন্য বন্দর চেয়ারম্যান ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে। কারণ, শিপমেন্ট ব্যাহত হলে পুরো রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৪১টি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত তাদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা পাঠিয়েছে বিজিএমইএকে। এসব প্রতিষ্ঠানের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্কে রপ্তানির কথা ছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ পণ্যের ক্রেতা সুইডেনভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম। এছাড়া টার্গেট, ওয়ালমাট, টপ গ্রেড, গ্যাস্টন, ওলওর্থস, ফিলিপস ভ্যান হিউসেন, পিভিএইচ, এমবিএইচ, চ্যাপ্টার ওয়ান, স্পোর্টস ওয়্যার, সিঅ্যান্ডএ বায়িং, নিউ ফ্রন্টেয়ার, রচি ট্রেডার্স ইনকরপো ও বিএএসএসের মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কেনা পণ্যও পুড়েছে সীতাকুণ্ডের আগুনে।

বিজিএমইএকে দেওয়া ক্ষয়ক্ষতির তালিকা অনুযায়ী, ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে চট্টগ্রামের সী-ব্লু অ্যান্ড সী টেক্সটাইল লিমিটেডের ১৬ লাখ ২৫ হাজার ২৫৫ ডলার, অ্যারো ফেব্রিক্স প্রাইভেট লিমিটেডের ৩ লাখ ২০ হাজার ৫০০ ডলার, ক্লিফটন গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠান ক্লিফটন টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেড, ভেনচুরা (বাংলাদেশ) লিমিটেড, ক্লিফটন কটন মিলস লিমিটেডের ২ লাখ ৯৮ হাজার ১৯০ ডলার, সুজি ফ্যাশনস লিমিটেডের ৪৪ হাজার ২২৬ ডলার, এভালন ফ্যাশন লিমিটেডের ২ লাখ ১৪ হাজার ৪২৯ ডলার, স্যানটেক্স অ্যাপারেলস লিমিটেডের ১ লাখ ৩৯৪ ডলার, ডিভাইন ইনটিমেটস লিমিটেডের ৩১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯৩ ডলার, ডিভাইন ডিজাইন লিমিটেডের ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৪ ডলার, বিলামি টেক্সটাইল লিমিটেডের ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫ ডলার, প্যাসিফিক জিনস্ লিমিটেডের ১৩ লাখ ডলার, কেডিএস অ্যাপারেলস লিমিটেডের ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৭৮ ডলার এবং কেডিএস গার্মেন্টস লিমিটেডের ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭ ডলার সমমূল্যের তৈরি পোশাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঢাকাসহ দেশের অন্য জেলার পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে স্টার্লিং ডেনিমস লিমিটেডের ১২ লাখ ৯ হাজার ১৭২ ডলার, হপ ইক (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ১৫ লাখ ৯৯ হাজার ৭৩১ ডলার, ক্রিসেন্ট ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইড লিমিটেডের ৯ লাখ ২ হাজার ১৫৭ ডলার, পাইওনিয়ার নিটওয়্যার (বিডি) লিমিটেডের ১০ লাখ ৮৯ হাজার ১৫৭ ডলার, কলম্বিয়া অ্যাপারেলস লিমিটেডের ১২ লাখ ১৫ হাজার ৭২৩ ডলার, কলম্বিয়া গার্মেন্টস লিমিটেডের ১২ লাখ ৯৫ হাজার ৫১৭ ডলার, এসএম নিটওয়্যারস লিমিটেডের ১১ লাখ ৬৭ হাজার ৩৬৭ ডলারের সমমূল্যের পোশাক ছিল বিএম ডিপোতে।

এছাড়া ওই ডিপোতে শিন শিন অ্যাপারেলস, কেএ ডিজাইন, জেএফকে ফ্যাশন, একেএইচ নিটিং অ্যান্ড ডাইং, ভার্সাটাইল টেক্সটাইল, রিও ফ্যাশন, ভিশন অ্যাপারেলস, ইমপ্রেস-নিটেক্স কম্পোজিট টেক্সটাইল, আমান টেক্সটাইল, আয়েশা ক্লথিং, আসওয়াদ কম্পোজিট, আরকে নিট, টিআরজেড, রেমি হোল্ডিংস, টারাসিমা অ্যাপারেলস, কেসি বটম অ্যান্ড শার্টস, ভ্যানগার্ড গার্মেন্টস, মাশিয়াতা সুয়েটাস, চৈতি কম্পোজিট, নিউওয়েজ অ্যাপারেলস, কেইলক নিউওয়েজ বাংলাদেশ, আরাবি ফ্যাশন, দিগন্ত সুয়েটার্স, তাকওয়া ফেব্রিক্স, ফাউন্টেন গার্মেন্টস, ম্যাগপি কম্পোজিট, পিমকি অ্যাপারেলস, অনন্ত অ্যাপারেলস, একেএইচ ইকো অ্যাপারেলস, একেএইচ ফ্যাশনস্, নিট এশিয়া লিমিটেড, অরুনিমা স্পোর্টস ওয়্যার, টার্গেট ফাইন নিট, হেসং কোরিয়া লিমিটেড, সেটার্ন টেক্সটাইলস ও ক্রিসেন্ট ফ্যাশন নামের প্রতিষ্ঠানগুলোরও পণ্য ছিল।

বিজিএমইএ ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা করলেও নিটওয়্যার প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফা), বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো তালিকা করেনি। শুধু তৈরি পোশাক নয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার শিল্পের রপ্তানি এবং আমদানি পণ্যও ছিল আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বিএম কনটেইনার ডিপোতে।

বেসরকারি ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডা’র তথ্যমতে, অগ্নিকাণ্ডের দিন অর্থাৎ গত ৪ জুন দিনগত রাত পর্যন্ত বিএম কনটেইনার ডিপোতে মোট চার হাজার ৩১৮টি কনটেইনার ছিল। এরমধ্যে দুই হাজার ৮৯৭টি ছিল খালি কনটেইনার। ৮৬৭ কনটেইনারে রপ্তানিপণ্য এবং বাকি ৫৫৪ কনটেইনারে ছিল আমদানিপণ্য।

বিকডার হিসাবে, সাধারণত প্রতি টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) কনটেইনারে গড়ে ৫০ লাখ টাকার পণ্য থাকে। সে হিসাবেও বিএম ডিপোর আগুনে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার আমদানি ও রপ্তানিপণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে কী পরিমাণ পণ্য পুড়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না জানালেও বিকডা সচিব রুহুল আমীন সিকদার বিপ্লব বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি তদন্ত করছে। একাধিক তদন্ত কমিটিও হয়েছে। ফলে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না।

এ বিষয়ে বিকেএমইএ চট্টগ্রামের পরিচালক গাজী মো. শহীদুল্লাহ বলেন, আমরা বিকেএমইএর পক্ষ থেকে একটি পোর্টাল খুলেছি। দু-একটি প্রতিষ্ঠান মৌখিকভাবে তথ্য দিয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনো পাইনি। আশা করছি, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্য তালিকা পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ রোববার (১২ জুন) দুপুরে বলেন, আমদানি বা রপ্তানির কোনো তথ্য শিপিং এজেন্টের কাছে থাকে না। এরপরও বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিদুর্ঘটনার পর এজেন্টগুলোর কাছে আমরা তথ্য চেয়েছি। কার কী পরিমাণ পণ্য সেখানে ছিল যেন জানতে পারি। পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেতে ক’দিন সময় লাগতে পারে।