চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা কার্গোপণ্য পরিবহনে লাইটারেজ ব্যবসায় ভেঙেছে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট। উন্মুক্ত পণ্য পরিবহনের কারণে ভাড়া কমেছে ২০-৩০ শতাংশ। ফলে কমছে উৎপাদন খরচ। লাভবান হচ্ছেন ভোক্তা। তবে এ সেক্টরের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা বলছেন, উন্মুক্তভাবে বাল্কপণ্য পরিবহনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন লাইটারেজ মালিকরা।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্য নিয়ে আসা জাহাজের প্রায় ৪৫ শতাংশই খোলা পণ্যবাহী। এগুলোতে বাল্ক ক্যারিয়ার বলা হয়। বাল্ক ক্যারিয়ারে চাল, ডাল, গম, ছোলা, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, কয়লা, পাথর, স্ক্র্যাপসহ নানান পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। পরে বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করা জাহাজ থেকে এসব পণ্যের প্রায় তিন চতুর্থাংশ লাইটারেজের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে দেশের ৩৪টি নৌ রুট রয়েছে। এসব রুটে প্রায় আড়াই হাজার লাইটারেজ জাহাজ চলাচল করে।
সূত্র জানায়, সরকারি কোনো নীতিমালা না থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাল্ক পণ্য পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) গঠন করে লাইটারেজ মালিকদের প্রভাবশালী কয়েকটি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতো সরকারদলীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। দীর্ঘ সময় ধরে এসব সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি ছিল বন্দরকেন্দ্রিক বাল্কপণ্য পরিবহন। ওই সিন্ডিকেটই পণ্যের লাইটারিংয়ের পরিবহন ব্যয় নির্ধারণ করে দিতো। এতে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। বেড়ে যেত পণ্যের পরিবহন ব্যয়।
২০২৩ সালে লাইটার মালিকদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হলে ভেঙে যায় ডব্লিউটিসি। এরপর নৌ-বাণিজ্য দপ্তরকে (এমএমডি) লাইটারেজ চলাচল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) গঠন করে দেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। এরপরেও জাহাজ মালিকদের মতনৈক্যের কারণে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বাল্কপণ্য পরিবহনে নৌপথের সিন্ডিকেটগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এতে আমদানিকারকরা সরাসরি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দর কষাকষির মাধ্যমে লাইটারেজ জাহাজ ভাড়ায় নিয়ে বাল্কপণ্য পরিবহন করছেন। ফলে আগের চেয়ে পণ্যের পরিবহন ব্যয় অনেকাংশে কমে গেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
দেশের শীর্ষ ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘রড উৎপাদনের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের বড় অংশই আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। আবার এই স্ক্র্যাপ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করা মাদার ভ্যাসেল থেকে আমাদের জেটিতে পরিবহনের জন্য ব্যবহার করতে হয় লাইটার জাহাজ। আগে লাইটার জাহাজ একটি সিন্ডিকেটের মধ্যে বন্দি ছিল। এখন সিন্ডিকেট না থাকায় ওপেন মার্কেটে লাইটার জাহাজ ভাড়ায় মিলছে।’
তিনি বলেন, ‘এতে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। যা আগে একচেটিয়া ছিল। একচেটিয়া থাকায় আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম দরে লাইটার ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এতে আমাদের পণ্য পরিবহন ব্যয় কমেছে। কস্ট অব প্রোডাকশনও কমবে। পণ্যের দামও কমবে। যার সুফল পাবেন ভোক্তারা।’
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে শীর্ষ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি চাল, ডাল, ছোলা আমদানি করে। বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে প্রায় সবকিছুই অস্বাভাবিকভাবে চলছে। পণ্য আমদানিও কিছুটা কমেছে। তবে দেশে ভোগ্যপণ্য সরবরাহে ঘাটতি নেই।’
এ আমদানিকারক ব্যবসায়ী বলেন, ‘বহির্নোঙরে অবস্থান করা জাহাজ থেকে চাল, ডাল, ছোলা, গমসহ নানান বাল্কপণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনে লাইটারেজ ব্যবহার করা হয়। এখন ডব্লিউটিসির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় লাইটারেজগুলো সরাসরি পণ্য পরিবহন করছে। এতে পরিবহন ব্যয় কিছুটা কমলেও পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত পুরো বিষয়টি বোঝা যাবে না।’
চট্টগ্রাম বন্দরের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বুধবার (২৮ আগস্ট) কনটেইনার ও নানান কার্গো পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ও বহির্নোঙরে ১১০টি জাহাজ অবস্থান করছিল। এর মধ্যে কনটেইনারবাহী জাহাজ রয়েছে ২৫টি এবং অয়েল ট্যাংকার ১৭টি। অন্য ৬৮টি জাহাজে রয়েছে স্ক্র্যাপ, কয়লা, পাথর, খাদ্যশস্য, সার, সিমেন্ট ক্লিংকার, র’ সুগারবাহী জাহাজ। বুধবার ৪৮টি জাহাজ থেকে এসব কার্গোপণ্য বহির্নোঙরে কার্গো খালাসরত অবস্থায় রয়েছে।
চট্টগ্রামে লাইটার জাহাজ ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ডব্লিউটিসি আগে থেকে নানান অনিয়মে জড়িত হয়ে পড়ে। এতে লাইটার জাহাজ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছিল। কিছুদিন আগে ডব্লিউটিসিকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ডব্লিউটিসি সক্রিয় নেই।’
তিনি বলেন, ‘এখন লাইটার ব্যবসায়ীরা আমদানিকারক কিংবা শিপিং এজেন্টের সঙ্গে কোটেশন কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে কার্গোপণ্য পরিবহন করছে। এতে লাইটার জাহাজ ব্যবসায় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে পণ্য পরিবহন ভাড়া কমেছে। বিশেষ করে আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা সিমেন্ট ক্লিংকার পরিবহন হতো টনপ্রতি ৫৮৩ টাকা হিসেবে। এখন সেই ভাড়া নির্ধারণ করা নেই। এখন কেউ ৪শ টাকা কেউ সাড়ে ৪শ টাকাতেও ক্লিংকার বহন করছে। একইভাবে অন্য কার্গোপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও ভাড়া কমেছে।’
ডব্লিউটিসিসির নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ খান বলেন, ‘আগে লাইটারেজ ব্যবস্থাপনা ছিল ডব্লিউটিসির অধীনে। এতে লাইটারেজ ব্যবসায় একটি শৃঙ্খলা ছিল। এখন সেই শৃঙ্খলা নেই। তবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্তে একটি পরিপত্র হওয়ার কথা।’
লাইটারেজ মালিকরা এখন যে যার মতো করে ভাড়া নিচ্ছেন জানিয়ে ডব্লিউটিসির এ কর্মকর্তা বলেন, এতে লাইটার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ অলস বসে না থেকে অনেকে খরচ পোষানোর জন্য পণ্য পরিবহন করছেন। তাতে পুরো সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘আমরা মূলত সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের নিবন্ধন দিই। সময়ে সময়ে এগুলো তদারক করি। সাগর থেকে নদীপথে চলাচলকারী কোস্টাল জাহাজগুলো (লাইটারেজ) বর্তমানে স্বাভাবিকভাবে চলছে। আগে একটি সংগঠন জাহাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো। তবে এখন উন্মুক্তভাবে জাহাজগুলো পণ্য পরিবহন করছে।’