দীর্ঘ প্রতিক্ষারর পর অবশেষে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজননক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে পরিপূর্ণ ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা মাছ। রবিবার দিবাগত দিবাগত রাত ২টা ৩০,মিনিট থেকে মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়ার পরপরই তা সংগ্রহ করছে শত শত ডিম সংগ্রহকারীরা। রাতে উৎসবমূখর পরিবেশে তারা ডিম সংগ্রহ করছেন।যদিও গত দুইমাস ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছে হালদার পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা।কয়েকদফা নমুনা ডিম ছাড়লেও আশার হাল ছাড়েনি তারা। শুক্রবারেও প্রবল বর্ষণে পাহাড়ী ঢল নামলেও ডিম না ছাড়ায় কিছুটা হতাশ হয়ে ছিল।উপজেলা প্রশাসনও প্রতিনিয়ত হালদায় মনিটরিংয়ে ছিল। নদীর পাড়ে অবস্থানে ছিল শতশত ডিম সংগ্রহকারীরা নৌকা আর বাঁশের বোরাক নিয়ে। রাতেই পুরোদমে ডিম ছেড়ে দেয়ায় উৎসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে হালদার পাড়ে। এর আগে সকাল থেকে কখনো জোয়ার, কখনো ভাটায় কার্প জাতীয় মা মাছের ডিম সংগ্রহে নদীর বিভিন্ন স্থানে তারা জাল ফেলে অবস্থান করতে থাকে। দুপুরের দিকে কিছু কিছু স্থানে নমুনা ডিম ছাড়লে আশায় বুক বাঁধে ডিম সংগ্রহকারীরা। সরেজমিনে দেখা গেছে হালদা নদীর আজিমের ঘাট, নতুনহাট,মাছুয়াঘোনা,নাপিতের ঘাট, আমতুয়া ও রামদাশ হাট, মুন্সির হাটএলাকা থেকে ডিম সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া হাটহাজারীর সোনাইর মুখ,অঙ্কুরীঘোন ও মোবারখিল এলাকায় ডিম সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। এর আগে গত ১৮ মে প্রথম দফা নমুনা ডিম ছাড়লেও আবহাওয়া অনুকূল না হওয়ায় সেইবার মা মাছ পরিপূর্ণভাবে ডিম ছাড়েনি।
ডিম সংগ্রহকারী মো: শফি বলেন, গত প্রায় দুই মাস ধরে এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আজ আশানুরূপ ডিম সংগ্রহ করতে পারছি। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এবার ডিমের পরিমাণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে রবিবার দুপুর থেকে জোয়ারের সময় প্রতি নৌকায় ১৫০ থেকে ৫০ গ্রাম নমুনা আসতে দেখা গেছে। দিনভর তারা পুরোদমে ডিম ছাড়বে কী ছাড়বে না এ নিয়ে অনেক ডিম সংগ্রহকারী হতাশায় ভুগছিলেন। কারণ আর মাত্র দুয়েক দিন সময় আছে চলমান জো'র এবং এ মৌসুমের শেষ জো এটি। দুই মাস ধরে অন্য পেশা বাদ দিয়ে তারা ডিমের আশায় নদীতে অবস্থান করছেন। ডিম না ছাড়লে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন অনেকে। এমন আশঙ্কা সংগ্রকারীদের মাঝে।কেননা অনেকের সংসার চলে অনেক কষ্টের।ঋণ করে অনেকেই এ দু মাস ডিস সংগ্রহ করার প্রস্তুতি নেয় কিছুটা লাভের আশায়।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, শেষ জোয়াতে (১৮ জুন) এসে আজ রাতে হালদা নদীতে রুইকাতলা ডিম ছেড়েছে।
পরিবেশ অনূকুলে আশা করা যাচ্ছে, রাতে বা চলমান জো’তে (২১ তারিখের মধ্যে) মা মাছ পুরোদমে ডিম ছেড়ে দিবে।
হাটহাজারী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো: ফারুক মায়েদুজ্জামান জানান, অনুকূল পরিবেশ থাকায় রোববার রাতে হালদা নদীতে পুরোদমে মা মাছ ডিম ছেড়েছে। সংগ্রহকারীরা উৎসবমুখর পরিবেশে ডিম সংগ্রহ করেছে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: শাহিদুল আলম মুঠোফোনে বলেন, রাত সাড়ে ১১টা থেকে নদীতে মাছ পুরোদমে ডিম ছেড়েছে। এখন ডিম সংগ্রহের কাজ চলছে। প্রায় রাত ৩টা পর্যন্ত সংগ্রহ চলে।এর আগে সকালে নমুনা ডিম ছেড়েছিল। দিনভর নদীতে ডিম আহরণকারীরা অপেক্ষায় ছিলেন।’
তিনি বলেন,শনিবার থেকে অমাবস্যার জো শুরু হয়েছে। ডিম সংগ্রহকারীরা নদীতে অবস্থান করছে। প্রশাসন সরেজমিনে পরিদর্শন করছে। সরকারি প্রতিটা হ্যাচারী প্রস্তুত রাখা হয়েছে।গত বছরের তুলনায় এবছর পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম ছেড়েছে মা মাছ।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর এপ্রিল-মে দুই মাসের যে কোনো সময় ডিম ছাড়ার ভর মৌসুমে নিষিক্ত ডিম আহরণ করতে ব্যস্ততার সীমা থাকেনা হালদাপারের ডিম সংগ্রহকারীদের।প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন বিভিন্ন নদী থেকে দেশীয় কার্প জাতীয় মাছ,রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালি বাউশ হালদায় আসে এবং এ সময়ের মধ্যে যেকোনো সময় ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার জন্য উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত হতে হয়। তাপমাত্রা, পানি, প্রবল স্রোত ও বজ্রবৃষ্টি ইত্যাদি মা মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে। চলতি মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এদিকে জালুবায়ু পরিবর্তন, মা মাছ শিকার, নদী দূষণসহ নানা কারণে মা মাছের ডিম দেয়া কমেছে। ২০২০ সালে হালদা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। পরের দুই বছর তা কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে যায়।
২০২১ সালে হালদা থেকে ডিম সংগ্রহ করা হয় সাড়ে আট হাজার কেজি। ২০২২ সালে তা আরো কমে হয় সাড়ে সাত হাজার কেজি।