নগরের লালদীঘির পাড়ের জেলা পরিষদ টাওয়ারে ঐতিহ্য কর্নার ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ একটি ঐতিহাসিক কাজ হবে বলে মন্তব্য করেছেন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন।
রোববার (২৩ জুন) দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সভায় চিরন্তন চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয় ও বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন।
আলোচনায় অংশ নেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, সাবেক মুখ্য সচিব এম এ করিম, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি আবুল মোমেন, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক, পিএচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ইস্পাহানি গ্রুপের কর্নধার সালমান ইস্পাহানি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. সেকান্দর চৌধুরী, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার পাশা, কবি রাশেদ রউফ, নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, ডা. মঈনুল ইসলাম মাহমুদ ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল।
সভায় চিরন্তন চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন গবেষক ও সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দার।
সভায় উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক, কবি কামরুল হাসান বাদল, চট্টগ্রাম ক্লাবের সভাপতি আবদুর রহিম, স্থপতি আশিক ইমরান, লেখক নেছার আহমদ, শিল্পী দীপক দত্ত ও আবৃত্তিশিল্পী বিশ্বজিৎ পাল।
সভা শেষে উপস্থিত সবাই ঐতিহ্য কর্নার স্থাপনের জন্য নির্ধারিত স্থান ঘুরে দেখেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। সমন্বয় করেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. দিদারুল আলম ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।
ড. অনুপম সেন বলেন, চিরন্তন চট্টগ্রাম ঐতিহ্য কর্নার স্থাপনের এই উদ্যোগ একটি ঐতিহাসিক কাজ হবে। এটি একটা মিউজিয়ামের আদলে তৈরি করা হবে। সার্বিকভাবে এতে বিশেষ ঘটনা ও বিষয়গুলো লাইট ও সাউন্ডের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হবে যাতে চট্টগ্রাম নতুন প্রজন্মের কাছে মূর্ত হয়ে ওঠে। পর্তুগিজরা চট্টগ্রাম দখল করেছিল। সন্দ্বীপ থেকে তারা লোকজন ধরে নিয়ে ইউরোপে বিক্রি করত। চট্টগ্রামে শাহ সুজা আসেন। আরাকানরা এসেছিল। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা এখানে তুলে ধরা হবে। তরুণরাই মূল কাজ করবে। বিশেষজ্ঞরা তাদের পরামর্শ দেবেন ও গাইড করবেন।
চিরন্তন চট্টগ্রামের গবেষক দলে মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবপ্রসাদ দাস দেবু, সাংবাদিক হামিদ উল্লাহ, মাসুদ মিলাদ, আলীউর রহমান, আল রাহমান, সুবীর মহাজন, আহসানুল কবির রিটন, সুজন ঘোষ, আবু মোশাররফ রাসেল, মিঠুন চৌধুরী, ওমর ফারুক, আবদুল্লাহ আল মামুন, রেজা মুজাম্মেল, অনুপম শীল, শৈবাল আচার্য্য, সুবল বড়ুয়া ও শারমিন রিমা।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, ঐতিহ্য কর্নারকে ডিজিটালাইজড করতে চাই। যেন বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে মানুষ সংযুক্ত হতে পারে। সবার পরামর্শে আমরা কাজটি এগিয়ে নিতে চাই। পুরো চট্টগ্রামকে মানুষ যেন এই কর্নার থেকে জানতে পারে।
সাবেক মুখ্য সচিব এম এ করিম বলেন, এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। চট্টগ্রামকে তুলে ধরতে এটি সুদূর প্রসারী ভূমিকা রাখবে।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, এই সংকলন যেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম ভিত্তিক হয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যেন এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। মানুষকে একীভূত রাখে ভাষা। চাটগাঁইয়া ভাষা যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তার সবটুকু যেন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
কবি আবুল মোমেন বলেন, স্বপ্নটা অনেক বড়। চিরন্তন চট্টগ্রাম বললে যেন সব কিছু চোখে ভেসে ওঠে। চট্টগ্রাম বঙ্গে সবচেয়ে প্রাচীন চলমান নগরী। অখণ্ড বাংলায় চট্টগ্রাম ছিল নেক্সট টু কলকাতা। পরে চট্টগ্রাম গুরুত্ব হারায়। তা তুলে ধরা দরকার। প্রদর্শনীর জন্য কিছু সামগ্রী সংগ্রহ করা যেতে পারে। সাগর, নদী, পাহাড়, হ্রদ ও সমতল মিলে চট্টগ্রাম। প্রকৃতির এমন ৫টি উপকরণ একসঙ্গে কোথাও পাওয়া যায় না। চট্টগ্রামের নারীদেরও অনন্য অবদান আছে ইতিহাসে। চিরন্তন চট্টগ্রামকে মিউজিয়ামের মতো করলে সবচেয়ে ভালো হয়।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক বলেন, এই উদ্যোগ হবে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পরবর্তী সংস্করণে বাদপড়া বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আছে। সব তথ্য যাচাই বাছাই করে দিলে ভালো হবে।
পিএচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান বলেন, এই উদ্যোগ সফল করার জন্য আমরা প্রতিদিন আসতে চাই। যে বিদ্যা কেবল জৈবিক চাহিদা মেটায় তা অপরিপূর্ণ বিদ্যা। এমন উদ্যোগ নেয়ায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম বলেন, এটা খুব ভালো উদ্যোগ। প্রস্তাবনায় দিকনির্দেশনা ৯০ ভাগ এসেছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের ব্যাপকতা, গভীরতা ও গুরুত্ব এতে উঠে এসেছে। তবে বাকি ১০ ভাগের জন্য আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে। সময় নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে।
ড. মোহীত উল আলম বলেন, এই উদ্যোগে আমরা চট্টগ্রামের স্বাতন্ত্র্য খোঁজার চেষ্টা করছি। এটা অনেক সময় বিপজ্জনক হয়। ঐতিহ্যের দিকে ফিরলে পরিমাণ ও সংযোগ সূত্র অনুসন্ধান জরুরি। তথ্যের চেয়েও ব্যাখ্যা বেশি দরকারি। প্রতি ১০ মাইলে চট্টগ্রামের ভাষা বদলে যায়। চট্টগ্রামের ভাষার বড় সম্পদ গালি। ঐতিহ্য কর্নার টেকনাফ থেকে যেন শুরু হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. সেকান্দর চৌধুরী বলেন, বঙ্গভঙ্গ চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ড. এনামুল হক রচিত ‘সুফিজম ইন বেঙ্গল’ এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ। চট্টগ্রামে সুফিবাদ শিরোনামে মুসলিম ঘরানার বিভিন্ন ধারাগুলো একসঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার পাশা বলেন, ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সীমারেখা ছিল কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বলতে টেকনাফ পর্যন্তই আমরা বুঝি। তা না হলে পরম্পরা মিস হয়ে যেতে পারে। দেশের বাইরে থেকেও যেন চট্টগ্রামের সন্তানরা যুক্ত হতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করে স্পেসের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
কবি রাশেদ রউফ বলেন, চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য বললে ভাষা ও সংস্কৃতি সবই আসে। ব্যক্তিত্বদের মধ্যে কতজনকে আমরা সম্পৃক্ত করব সেটা ঠিক করতে হবে। প্রস্তাবনা আসলে তা চূড়ান্ত করে নিতে হবে।
নাট্যজন আহমদ ইকবাল হায়দার বলেন, কিছু সংযোজন বিয়োজন প্রয়োজন। এটা অনেক ব্যাপক কাজ। একটা পর্যায় পর্যন্ত কাজ শেষ করে ফেলা যায়। তারপর আবার আপডেট করার সুযোগ থাকবে।
ডা. মঈনুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, এটি ইতিহাসকে একীভূত করার প্রয়াস। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল বলেন, জেলা পরিষদ ভবনের ১৪ তলা যেখানে ঐতিহ্য কর্নার স্থাপন করা হবে। সেটি কাজের জন্য প্রস্তুত। তাই, তরুণ ও সম্ভাবনাময় সাংবাদিক ও গবেষকদের একটা টিম তৈরি করে প্রাথমিকভাবে তথ্যসংগ্রহ ও গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে।