১৯৭১ সালে পুরো দেশজুড়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতন। নারী ও শিশু, তরুণ-যুবকদের প্রতি যে বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার বিবরণ ইতিহাসে খুব কমই আছে। রক্তাক্ত সেই কালো অধ্যায়ের অনেক কিছুই হারিয়ে গেলেও এখনো যা আছে তা সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী মানুষরূপী পশুদের জঘন্য কর্মকাণ্ডের এক দলিল। সে নির্যাতনের শিকার হন দোহাজারী জামিজুরীর কয়েকটি হিন্দু পরিবার। সেখানে ১৬ জনের অধিক লোককে দিন দুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে একই গর্তে সবাইকে পুঁতে ফেলা হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে একসাথে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হতো বা গণকবর দেওয়া হতো, সে সকল গণ কবরই আজকের বধ্যভূমি। সুতরাং, বধ্যভূমি হলো এমন একটি স্থান যেখানে মুক্তিগামী বাঙ্গালীর উপর অত্যাচারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধের সময় হত্যাকৃতদের একাতারে গণকরব বা মাটিচাপা দিয়ে রাখা হতো। ‘যারা পূর্ব বাংলায় গণহত্যা করেছে শহরে, গ্রামে, টিলায়, নদীতে, ক্ষেত ও খামারে সেসব নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু বর্তমানেও অভিশপ্ত পাকহানাদার বাহিনী। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভার একমাত্র জামিজুরী বধ্যভূমি পাক হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক নৃশংসতার স্বাক্ষী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। এরপর পাক হানাদার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালী নিধনে। বাঙালী নিধনের অংশ হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত এলাকাগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় হানাদার বাহিনী মানব হত্যার নিমর্মতায় মেতে উঠে ছিল সেদিন চন্দনাইশ (তৎকালীন পটিয়া থানার) দোহাজারী জামিজুরী গ্রামে। ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল, বাংলা ১৩৭৮ সালের ১৪ই বৈশাখ পাক হানাদার বাহিনী তৎকালীন পটিয়া (বর্তমানে চন্দনাইশ) থানার দোহাজারী’র জামিজুরী গ্রামে নারকীয় তান্ডবলীলা চালিয়ে ১৬ জনের অধিক নিরপরাধ নিরীহ ব্যক্তি হত্যা করে। সারা দেশের মত এ গ্রামটিও রক্তে রঞ্জিত হয় ৭১’র এ দিনে। তার মধ্যে ১৩ জন জামিজুরী গ্রামের অধিবাসী ছিলেন শহীদ হন ডাঃ বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্য, কবিরাজ তারাচরণ ভট্টাচার্য, মাষ্টার প্রফুল্ল রঞ্জন ভট্টাচার্য, মাষ্টার মিলন ভট্টাচার্য, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, রেনু বালা ভট্টাচার্য, ডাঃ করুনা কুমার চৌধুরী, হরি রঞ্জন মজুমদার, মহেন্দ্র সেন, নগেন্দ্র ধুপী, রমনী দাশ, অমর চৌধুরী ও মনীন্দ্র দাশ। স্থানীয় এলাকাবাসী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশগুলো একত্রিত করে একটি গর্তে সমাধিস্থ করে। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা সুভাস মজুমদার (উত্তর আমিরাবাদ) ও মুক্তিযোদ্ধা বিমল দাশ (নলুয়া) ও মনীন্দ্র দাশ (মুজাফরাবাদ) এবং আরও অনেক নাম না জানা বক্তির দেহাবশেষও এখানে সমাধিস্থ করা হয়। স্বাধীনতার পর স্থানীয় ক’জন প্রগতিশীল তরুণের অক্লান্ত পরিশ্রমে সমাধিস্থলে গড়ে তোলা হয় বধ্যভূমি। স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, দীর্ঘদিন অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকার পর ২০০৭ সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার খালেদ রহিম জামিজুরী বধ্যভূমির ফলক উম্মোচন করেন। এরপর ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের অর্থায়নে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে বধ্যভূমি স্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে প্রায় সময় প্রশাসনের বিভিন্ন লোকদের ছবি তুলে পাঠাতে বলে দায়িত্ব সারেন। দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও পাক হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসর-রাজাকার, আলবদরদের বিচার হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং একান্ত আন্তরিকতার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেও এখনো এদেশীয় দোসর-রাজাকার, আলবদরদের বিচার হয়নি। এদের হাতে নির্মমভাবে সেদিন শহীদ হয়েছিল এই এলাকার ১৪ জন। এ সকল শহীদদের পরিবার-পরিজনের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখার গরজ কেউ অনুভব করেনি অদ্যবধি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়সহ স্থায়ী রাষ্ট্রীয় কোন আনুকূল্যও তাদের ভাগ্যে জুটেনি। জামিজুরী বধ্যভূমি পরিদর্শনে গিয়ে কথা হয় ৩ (তিন) গণ্ডা ভূমি দাতা ও শহীদ ডাঃ বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্যের ছেলে চাগাচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (অবঃ) প্রধান শিক্ষক, বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সুশীল কান্তি ভট্টাচার্য’র সাথে। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার অনেক বছর কেটে গেলেও ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল লোমহর্ষক হত্যাকান্ডে নিহতদের পরিবারগুলোর কথা স্মরণ করার জন্য যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এই বধ্যভূমির পরিচর্যা করে যাব। নিয়মিত কোন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য কিংবা অনুদান ছাড়া পরিচর্যার কাজ করা তার জন্য অনেক কষ্টের হলেও দেশ স্বাধীনে আত্মদানকারী শহীদদের সেবা করতে পেরে নিজেকে সান্তনা দিচ্ছে জানান। এই দেশের জন্য যে সকল ব্যক্তি শহীদ হয়ে আমাদেরকে ঋণী করে গেছেন তাদের ঋণ কমানোর চেষ্টা করছেন ” জামিজুরী শহীদ স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ কমিটির উদ্যোগে স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় বলেও জানান তিনি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য পাওয়া যাক বা না যাক প্রতি বছর ১৪ বৈশাখ স্থানীয়ভাবে এ বেঁধিমূলে দিনব্যাপী স্মৃতিচারণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সে অনুষ্ঠান আয়োজনেও বাঁধাগ্রস্থ হয় অনেক সময়। অনুষ্ঠান করার জন্য ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এলাকাবাসী চান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনে ইতিহাস সংরক্ষণে সরকারিভাবে এ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করা হোক। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানেনা জামিজুরীতে একটি বধ্যভূমি আছে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে কার্যকর ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন অগ্রজদের এবং প্রয়োজনে সরকারি উদ্যোগে পাঠ্য বইতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ করেন। সরকারি উদ্যোগে বধ্যভূমিটি রক্ষণাবেক্ষণেরও দাবি জানান তিনি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, জামিজুরী গণহত্যা দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল সকালে জামিজুরী গ্রামবাসীর পক্ষে শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা জানান এলাকাবাসী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। জামিজুরী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রভাষ দাশ গুপ্ত (অবঃ শিক্ষক) আক্ষেপ করে বলেন- বধ্যভূমিতে যাওয়ার রাস্তাটি করার জন্য এলজিইডি তেকে বরাদ্ধ হলেও নিম্নমানের কাজ করায় রাস্তাটির বিভিন্ন জায়গায় ভেঙ্গে গিয়ে ইট উঠে যাওয়ায় অনেক দর্শনার্থীর যেতে কষ্টে হচ্ছে এবং কষ্ট করে গেলেও বিশুদ্ধ পানির অভাবে তারা পরিদর্শন না করে দ্রুত চলে আসেন। বছরের নির্দিষ্ট বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে চাঁদের পর্যাপ্ত আলোর অভাবে অন্ধকারের জন্য রাতে কোন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উক্ত সমস্যাগুলো নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করেন।