কক্সবাজার ইসলামিয়া মহিলা কামিল (মাস্টার্স) মাদরাসার চেয়ারের জন্য সাবেক বর্তমান দুই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অনিয়াম, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতির অভিযোগ মিলেছে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাহমুদুল করিম ফারুকীর কারণে প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এরই মধ্যে ব্যক্তিগত অপারগতা দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি এডভোকেট আবুল কালাম সিদ্দিকী।
এই সুযোগে সভাপতি পদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন সাবেক অধ্যক্ষ জাফরুল্লাহ নূরী।
অন্যদিকে এমপিও বাতিল, চাকরীচ্যুতির পরেও ক্ষমতার চেয়ার ধরে রাখতে নানা ফন্দি আঁটতে থাকেন মুহাম্মদ মাহমুদুল করিম ফারুকী।
তারই ধারাবাহিকতায় ৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫ টায় তিনি জরুরি সভা ডাকেন। যদিওবা ওই বৈঠক বয়কট করেছেন অধিকাংশ সদস্য।
পদত্যাগের কারণ জানতে চাইলে এডভোকেট আবুল কালাম সিদ্দিকী বলেন, মাদরাসার সবদিকে অনিয়ম দুর্নীতি। এখানে থেকে নিজের সম্মানহানি করতে চাই না। তাই পদত্যাগ করেছি।
৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মাদরাসায় গেলে দেখা যায়, শিক্ষক মিলনায়তনে কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে বৈঠক করছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহমুদুল করিম ফারুকী। প্রতিবেদক দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর নানা অভিযোগের বক্তব্য নিতে অফিসে গেলে কোন ধরণের মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
শুধু এতটুকু বলেন, "অনেক দিন অসুস্থ ছিলাম। কেউ খবর রাখেনি। এখন চারিদিকে শত্রু। ষড়যন্ত্র চলছে। আমার বলার কিছু নাই।"
এতিমখানার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, "সেটির আলাদা কমিটি আছে। সাধারণ সম্পাদক জাফরুল্লাহ নূরী। তারা সব নিয়ন্ত্রণ করে।"
মাদরাসার অভিভাবক ফোরামের সভাপতি ছৈয়দ উল্লাহ বলেন, একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট পুরো মাদরাসাকে জিম্মি করে এখানকার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে। পুরো প্রতিষ্ঠানকে একটি অনিয়ম, দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে ফেলেছে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাহমুদুল করিম ফারুকীর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর জালিয়াতি, টাকা আত্মসাৎসহ অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সে কারণে তার এমপিও বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। সে হিসাবে তিনি আর শিক্ষক পদেও থাকতে পারেন না।
পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক, ২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে সহকারী অধ্যাপক ফরিদুল আলমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। সেই সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে আছে। জৈষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন করে পছন্দের অন্যজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগের পাঁয়তারা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, জাফরুল্লাহ নূরী দায়িত্বকালে নামে বেনামে বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এখনো সেই মজা ছাড়তে পারছেন না। তাই সম্পূর্ণ জালিয়াতি করে নিজে দাতা সদস্য হয়ে এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি হয়েছেন। এডভোকেট আবুল কালাম সিদ্দিকীকে পদত্যাগ করিয়ে নিজে সভাপতি হওয়ার পাঁয়তারা করছেন।
এদিকে, গত ২৩ জানুয়ারি কমিটি গঠন সংক্রান্ত পত্র জারি করেন ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো: রেজাউল হক।
কমিটিতে জেলা প্রশাসক সভাপতি, জেলা শিক্ষা অফিসার বিদ্যোৎসাহী প্রতিনিধি, মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক শিক্ষক প্রতিনিধি, আবুল কাশেম সিকদার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান অধ্যক্ষকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
সেই কমিটি অনুসারে নিয়মিত কার্যক্রম চালছে। হঠাৎ বর্তমান এডহক কমিটির কোন রেজুলেশন বা কমিটির অজান্তে এডভোকেট আবুল কালাম সিদ্দিকী সভাপতি, জাফরুল্লাহ নূরীকে সহ সভাপতি করে কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিষ্ঠাতার তালিকায় তৎকালীন সভাপতি জেলা প্রশাসকের অনুমোদন নেই। জালিয়াতি করে সভাপতি হয়েছেন জাফরুল্লাহ নূরী। নেপথ্যে কাজ করেছেন মুহাম্মদ মাহমুদুল করিম ফারুকী।
এদিকে গত বছরের ২৭ জুলাই জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর প্রেরিত পত্র থেকে জানা গেছে, ১০ জানুয়ারী থেকে এডহক কমিটির সভাপতি হিসাবে জেলা প্রশাসক সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। সে হিসাবে নিয়মিত কমিটি গঠনের লক্ষ্যে ইমকামাক/নি/জিবি/২৯৫৮/০২ ২৮/৪/২০২৩ তারিখে জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষরে বিদ্যোৎসাহী পুরুষ সদস্য নির্বাচনের জন্য ৩ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ছৈয়দুল হক সিকদার নামের একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যা জেলা প্রশাসকের প্রস্তাবে ছিলই না। জেলা প্রশাসকের উক্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ইসলামিয়া মহিলা কামিল মাদরাসার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহমুদুল হক ফারুকী কর্তৃক সভাপতির অগোচরে এমন কর্মকান্ড করা হয়েছে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কর্মকান্ড পক্ষপাতদুষ্ট এবং শিক্ষার পরিবেশের অন্তরায়। যা বর্তমানে অভিভাবক শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়দের মাঝে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। তাই জনৈক ছৈয়দুল হক সিকদারের মনোনয়ন বাতিল করে আসল প্রস্তাবিত চিঠি হতে মনোনয়ন প্রদানসহ বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহমুদুল হক ফারুকীর এমপিও বতিল সহ শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন। যার প্রেক্ষিতে তার এমপিও বাতিল হয়।
আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ১৯৭৮ সালে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আমি সর্বকনিষ্ট সদস্য। কমিটিতে ছিলেন মরহুম এডভোকেট ছালামত উল্লাহ, মাওলানা মুক্তার আহামদ, মাওলানা ছাবের, শাহ নেওয়াজ।
আমি এ পর্যন্ত ৫ কোটি টাকার উপরে মাদরাসায় দান/সহায়তা করেছি। মাদ্রাসা আজকের অধঃপতনের মূলে জাফরুল্লাহ নূরী।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এডভোকেট ছালামত উল্লাহ বেঁচে থাকতে তাকে "মৃত" দেখিয়ে কমিটি করেন। সেখানে তার আত্মীয় স্বজনকে এনেছেন। জাফরুল্লাহ নূরী মাদ্রাসা এবং এতিম খানাকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখিয়ে এসডিএআর নামের একটি এনজিও করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য এনে আত্মসাৎ করেছেন। গত বছর একটি এনজিও থেকে মাদরাসার জন্য আনা ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন, যা তদন্তে প্রমাণ পেয়েছিল তৎকালীন জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ। জাফরুল্লাহ নূরীকে রেজুরেশন করে সেই টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, আমাকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নয় বলে হাইকোর্টে মামলা করেছেন। আমি সম্মানের কারণে এখন আর মাদরাসাতে যাই না। শুধুমাত্র এতিম খানায় একটি দায়িত্বে আছি। সেখানেও কম যাই।
জাফরুল্লাহ নূরী এতিমখানা কমিটির সেক্রেটারি। আবার একই ব্যক্তি কিভাবে মাদরাসার কমিটিতে থাকতে চান? তাছাড়া তিনি সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন। বর্তমানে অবসরে আছেন। বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখলাম না, জানালেন আবুল কাশেম সিকদার।
কয়েকজন শিক্ষক জানান, সাবেক অধ্যক্ষ জাফরুল্লাহ নূরী তার শ্যালক আবুল মনছুরকেও মাদরাসার দাতা সদস্য বানিয়েছেন। যা অনিয়মতান্ত্রিক ও অস্বাভাবিক।
এ ব্যাপারে জাফরুল্লাহ নূরী বলেন, আমি নিয়ম অনুযায়ী কমিটির সহ সভাপতি হয়েছি। এখানে বলার কিছু নাই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা অফিসার মো: নাছির উদ্দিন বলেন, গত ২৪ জানুয়ারি পরিচালনা কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অধ্যাপক ফরিদুল আলমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন সভাপতি। এই জটিলতা নিরসনে জেলা প্রশাসনকে উদ্যোগী হওয়া দরকার।
তিনি বলেন, শুনেছি, ৬ ফেব্রুয়ারি একটা মিটিং হয়েছে। কেউ করে থাকলে সেটা অবৈধ।
এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।