আজ শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের কাজ শেষ ৬৫ শতাংশ

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ৩০ নভেম্বর ২০২১ ১১:৪৯:০০ পূর্বাহ্ন | কক্সবাজার প্রতিদিন

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেললাইন স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। এরই মধ্যে বসানো হয়েছে কক্সবাজার অংশের প্রায় ১০ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক। আইকনিক রেল স্টেশন, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিং, হাইওয়ে ক্রসিংয়ের নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। তখন ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যাবে রেল।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন পর্যন্ত এই মেগা প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে চেষ্টা করছেন তারা। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে ট্রেন। তখন কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনাসহ সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে। কক্সবাজারে পর্যটনসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঘটবে বিপ্লব।

তবে নিখুঁতভাবে নির্মাণকাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর আবেদন করেছে রেলওয়ে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, ‘যে গতিতে রেললাইন স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০২২-এর জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তবে প্রকল্পের কাজ শেষ হলেই সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন চলবে এমনটি নয়। পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের পর বিভিন্ন ত্রুটি ধরা পড়বে। এগুলো সংশোধনে আরও এক বছর সময় লাগতে পারে।’

‘সবকিছু বিবেচনা করে আমরা গত জুনে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর আবেদন করেছি। তবে সরকার এখনো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায়নি। জমি অধিগ্রহণ, বনাঞ্চলে গাছ ও পাহাড় কাটার জটিলতা এবং করোনার কারণে প্রকল্পের কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে।’ অন্যথায় নির্ধারিত সময়েই সব কাজ শেষ করা সম্ভব হতো বলে জানান তিনি।

২০১০ সালের ৬ জুলাই ‘দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেললাইন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।

কিন্তু জমি অধিগ্রহণ, বনাঞ্চল নিরাপদ রাখার জটিলতাসহ নানাভাবে প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হয়। তখন এ প্রকল্পের সংশোধিত এডিপি অনুমোদিত হয় ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল। পরে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ প্রকল্পে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।

 

রেলওয়ে সূত্র জানায়, পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কিংয়ের আওতায় আনা, পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন, সহজ ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহনের উদ্দেশ্যে এই রেললাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫২ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণ হবে। তবে রামু থেকে রেললাইন যে পথে যাবে, সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসতি গড়ে ওঠায় এ অংশের কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৩৯১ হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

গত ৩১ অক্টোবর ‘দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দোহাজারী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৩৯টি বড় সেতু, ১৪৫টি কালভার্ট, বিভিন্ন শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং, হাতি চলাচলে আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ, ৯টি নতুন স্টেশন নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজগুলোকে দোহাজারী থেকে চকরিয়া ও চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত লটভিত্তিক দুই ভাগে ভাগ করেছে রেলওয়ে। এই দুটি লটের কাজ যথাক্রমে ১ জুলাই ২০১৮ ও ১ মার্চ ২০১৮ সালে শুরু হয়।

এর মধ্যে দোহাজারী থেকে চকরিয়ায় ১৯টি ব্রিজের মধ্যে সবগুলো নির্মাণকাজ চলমান। ১১৪টি কালভার্টের মধ্যে ৪২টির কাজ শেষ হয়েছে। ৩৫টির কাজ চলমান। দোহাজারী, হারবাং ও চকরিয়ায় স্টেশন ভবন নির্মাণকাজ চলছে। একই সঙ্গে চলছে রেলওয়ে ট্র্যাক (প্রায় তিন কিলোমিটার) সংযোজনের কাজ। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৬৮৭ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা। এই অংশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে সিআরইসি ও তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।

একইভাবে চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ২০টি সেতুর মধ্যে ১৬টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৪টির নির্মাণ কাজ চলমান। ১১০টি কালভার্টের মধ্যে ৬৬টির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৩৪টির কাজ চলছে। ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ ও কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণকাজ চলমান। এরই মধ্যে ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার অংশে রেলওয়ে ট্র্যাক সংযোজন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিইসিসি ও মেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল লিমিটেড। এ অংশের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ৫০২ দশমিক শূন্য ৫ কোটি টাকা।

 

 

কক্সবাজার সদর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে রশীদ নগর এলাকা। সরেজমিনে ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রশীদ নগর এলাকা অংশে রেল ট্র্যাক বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিইসিসি ও মেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল লিমিটেড। এ অংশে তারা ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার ট্র্যাক বসিয়েছে।

কক্সবাজার সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র জিয়াউল হক জিয়াম। তার বাড়ি রশীদ নগরে। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের মানুষের প্রাণের দাবি ছিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপন করা। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। সারাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে। এতে কক্সবাজারে পর্যটক কয়েকগুণ বাড়বে।’

তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে এই রেলপথ। এলাকার ব্যবসায়ীরা খুব সহজে পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে পারবেন। কক্সবাজারের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ চট্টগ্রাম তথা দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করতে পারবেন।’

 

কক্সবাজার সদর থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকা। শনিবার (২৭ নভেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, এই এলাকার ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন। এর মধ্যে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটির আয়তন ১ লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা এ ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করছেন শ্রমিকরা। নিচতলায় বোর্ডে আইকনিক টাওয়ার ও রেলস্টেশন প্ল্যাটফর্মের থ্রিডি নকশা টাঙানো। এই নকশা আইকনিক স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন এই আইকনিক ভবন ঘেঁষে হচ্ছে রেলওয়ের প্ল্যাটফর্ম। সেখানে ইট-পাথর-বালি দিয়ে প্ল্যাটফর্ম উঁচু করার কাজ চলমান। এছাড়া পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের কাজ শেষ পর্যায়ে।

আইকনিক স্টেশন ঘুরে দেখাচ্ছিলেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের উপ-পরিচালক (পুনর্বাসন) মো. সেলিম। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের অবকাঠামোর মধ্যে আইকনিক স্টেশনটি সবচেয়ে নানন্দিক। ঝিনুকের আদলে তৈরি এ ভবনটি অন্যান্য স্টেশন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থা, ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দিনে ৪৬ হাজার মানুষ এই স্টেশন দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারবে।’

‘চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এখন সিঙ্গেল লাইন স্থাপন করা হলেও ভবিষ্যতে ডাবল লাইন স্থাপনের জায়গা অধিগ্রহণ করা আছে। চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো সময় এটি ডাবল লাইন করা হবে। তখন সিঙ্গেল লাইন দিয়েও ঢাকা থেকে কক্সবাজার ট্রেনে ৮ ঘণ্টায় যাতায়াত করা সম্ভব হবে।’