আজ সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কক্সবাজারে প্যারাবনে অগ্নিসংযোগ: নির্মিত হচ্ছে রিসোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : রবিবার ২ এপ্রিল ২০২৩ ১১:২৮:০০ পূর্বাহ্ন | কক্সবাজার প্রতিদিন

কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে প্যারাবন উজাড় ও দখল করে কিংশুক ফার্মস লিমিটেডের রিসোর্ট তৈরির কাজ চলছে বিনা বাধায়। আগুন দিয়ে প্যারাবন উজাড় করা হচ্ছে। মুছে ফেলা হচ্ছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের চিহ্ন। প্রকাশ্যে দিবালোকে এক্সকাভেটর দিয়ে চলছে প্যারাবন নিধন যজ্ঞ। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নিধনের কাজ থামান যাচ্ছে না।

এতে পাখির আবাসস্থল নষ্টের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট না থাকলে শুধু সমুদ্র সৈকত নয়, মেরিন ড্রাইভ সড়কসহ পার্শ্ববর্তী জনপদ ও সাগরের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।  

গত এক মাসের অধিক সময় ধরে চলমান রয়েছে প্যারাবন নিধন যজ্ঞ। এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্যারাবন নিধনের একাধিবার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দখলদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠনের নেতারা বলছেন, প্যারাবন দখল করে রিসোর্ট ও মাছের খামার তৈরির সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। এর পেছনে খরচ হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এ কারণে অনেকে চুপ করে আছেন।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজারের প্যাঁচারদ্বীপের ভরাখালে ২৫ থেকে ৩০ একরের মতো প্যারাবন আছে। প্রায় ২০ বছর আগে উপকূলীয় বন বিভাগ এই প্যারাবন সৃজন করেছিল। প্যারাবনে ৪০ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ছিল। কিন্তু এক মাস ধরে কিংশুক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের লোকজন প্যারাবনের অন্তত ৩৫ হাজার গাছপালা উজাড় করে রিসোর্ট ও মাছের খামার তৈরি করছেন। প্রতিষ্ঠানটি বনের ভেতরে ৭০০ ফুট লম্বা পাকা দেয়াল তুলে ১০ একরের বেশি প্যারাবন দখলে নিয়েছে। প্যারাবনের ভেতরে গাড়ি চলাচলের মতো রাস্তা ও মৎস্য খামারের বেড়িবাঁধ নির্মাণ অব্যাহত আছে। এখন আগুন দিয়ে ছয় একরের বেশি প্যারাবন ধ্বংস করা হয়েছে। অবশিষ্ট ২০/২৫ একর প্যারাবনও নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সরকারি দপ্তরের কেউ সেখানে যাননি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কিংশুকের দখল করা প্যারাবনের দক্ষিণ পাশের অংশটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া পোড়া কেওড়া ও বাইনগাছগুলো স্থানীয় লোকজন কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। কিংশুকের দখল করা প্যারাবনের ভেতরের গাছগুলোও কেটে ফেলা হচ্ছে। এ কাজে বাধা দেওয়ার মতো কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি।

দখল করা প্যারাবনের পূর্ব দিকে টাঙানো একটি সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে-‘কিংশুক ফার্মস লিমিটেড, রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তবে সাইনবোর্ডে মালিকের নাম ও যোগাযোগের ঠিকানা কিংবা মুঠোফোন নম্বর উল্লেখ নেই। সাইনবোর্ডের পশ্চিম পাশে তৈরি করা হয়েছে একটি টিনের ঘর। কিংশুকের পক্ষে দখলে নেওয়া প্যারাবন স্থানীয় কয়েকজন লোক দেখাশোনা করেন। প্যারাবন দখল ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ সামলাচ্ছেন কিংশুকের ব্যবস্থাপক মশিউর আলম। প্যারাবন দখল করে তৈরি হয়েছে ইটের সীমানা দেয়াল।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য  মশিউরের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি ধরেননি। এ কারণে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, প্যারাবন হলেও সেটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা। রেজিস্ট্রিমূলে কিংশুক প্যারাবন কিনে সেখানে অবকাঠানো নির্মাণ করছে। খামারের জন্য সম্প্রতি বেড়িবাঁধ ও চলাচলের রাস্তা তৈরি হয়েছে। সেখানে বহু আগে পাকা দেয়াল তোলা হয়েছে। বিভিন্ন  গণমাধ্যমেও এ–সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রশাসন চুপ থাকায় জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে।

প্যারাবনে কিংশুকের রিসোর্ট নির্মাণের কাজ চলছেই কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে। কিংশুক কর্তৃপক্ষের সাইনবোর্ড প্যারাবনের এলাকাটি পড়েছে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে।

এই ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম সোহেল বলেন, দখল ও আগুনে ধ্বংস করা প্যারাবন ২০ থেকে ২৫ বছর আগে সৃজন করা হয়েছিল। একসময় প্যারাবনে মাছ শিকার করতেন এই এলাকার মানুষ। এ ছাড়া এই বন ঝড়–জ্বলোচ্ছাস থেকে উপকূলকে রক্ষা করে। তবে এক মাস ধরে প্যারাবন নিধন হচ্ছে। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞে বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই।

এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, এভাবে প্যারাবন দখলের কারণে পাখির আবাসস্থল নষ্টের পাশাপাশি সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। গভীর সমুদ্র থেকে মা কচ্ছপের ডিম পাড়া বন্ধ হয়ে গেছে। অবিলম্বে দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা ও প্যারাবনের ভেতরে তৈরি বেড়িবাঁধ ও পাকা দেয়াল উচ্ছেদ করা না হলে কক্সবাজারবাসী মাঠে নামবে।

পরিবেশবাদী একাধিক সংগঠনের নেতারা বলেন, কিংশুক কর্তৃপক্ষের দেখাদেখি অন্য প্রভাবশালীরা প্যারাবনের প্রায় ৩৮ একর জমি দখলে নিতে খুঁটি পুঁতেছে। রাতের অন্ধকারে এসব প্যারাবনও নিশ্চিহ্ন করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমির রঞ্জন সাহা বলেন, প্যারাবনের গাছ উজাড় করে যেখানে স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে, তা উপজেলা ভূমি প্রশাসনের জায়গা। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিলে উপজেলা প্রশাসন নিতে পারে।

আগুনে প্যারাবন ধ্বংসের বিষয়ে জানতে চাইলে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা মুস্তফা বলেন, এ ঘটনা তার জানা নেই। খোঁজখবর নিয়ে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।

এর আগে ইউএনও প্যারাবন দখল ও নিধনের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা জানালেও  অদ্যবধি  দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউএনও ফাহমিদা মুস্তফা বলেন, প্যারাবন নিধনের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা করার কথা। প্যারাবনের জায়গার মালিকানা চিহ্নিত করার জন্য স্থানীয় ভূমি অফিসের তহশিলদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তহশিলদার প্রতিবেদন দিয়েছেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কাছেও লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। সেখানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর বন উজাড়কারীদের বিরুদ্ধে নামে মাত্র মামলা করে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।

মামলার বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করেও পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, তিনি ঢাকায় প্রশিক্ষণে আছেন। তবে কিছুদিন আগে হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্যারাবন উজাড়, বেড়িবাঁধ ও সীমানাদেয়াল নির্মাণের দায়ে কিংশুকের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে এ মামলার দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। 

এ দিকে কক্সবাজারের পেঁচারদ্বীপের ইসিএ এলাকায় পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়ে ন্যচার কনজার্ভেশন ম্যানেজম্যান্ট (নেকম) নামের একটি প্রতিষ্টান ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সৃজন করেছেন। গত ২০০৩ সালে সেখানে তারা ৭/৮ একর জায়গা জুড়ে প্যারাবন সৃজন করেন। অবশ্য আগে থেকেই সেখানে ন্যচারেল ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট ছিল বলে ছিল বলে জানিয়েছেন নেকমের উপ পরিচালক ড. শফিকুর রহমান।  তিনি  আরও বলেন, যারা পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস করে ফরেস্ট উজাড় করছেন, আইনের দৃষ্টিতে তা গর্হিত অপরাধ।এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার বলে ও মনে করেন এ বিজ্ঞানী।