কেউ যদি দূরদর্শী হয়, আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, সমাধান আছে-এমন ধারণা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তাহলে সে কাজটি পারবেই। এমনই একজন অদম্য সাহসী নারী অ্যাডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী।
যিনি চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে জাতীয় সংগীত ও জয় বাংলা শ্লোগানের প্রচলন সৃষ্টিতে অনেকটাই সফল হয়েছেন।
মফস্বলে কিংবা শহরে বসবাসরত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের অনেক শিশুরই পড়াশোনার শুরুটা হয় ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে।
পরবর্তীতে এই শিশুদের এক অংশ চলে যায় স্কুলে, আরেক অংশের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু হয় মাদ্রাসাতে৷ নিজেদের নয়, অভিভাবকের আকাঙ্ক্ষাতে বদলে যায় তাদের চাওয়া পাওয়া, সুযোগ সুবিধাগুলো৷ ফলে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জাতীয় সংগীত চর্চার কোন প্রচলন যেমন নেই, তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কোন ধারণা নেওয়ার প্রযোজনও অনুভব করে অভিভাবক, শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের কেউই।
জিনাত সোহানা পেশায় একজন আইনজীবী । আইন পেশার পাশাপাশি সুচিন্তা ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের বিভাগীয় সমন্বয়ক। নির্যাতিত নারীদের অধিকার আদায়ের প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে তার কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি । কাজ করেছেন চট্টগ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেম জাগানোর মহান ব্রত নিয়ে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে জাতীয় সংগীত প্রচলনের এমনই এক কঠিন চ্যালেঞ্জ সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন জিনাত সোহানা চৌধুরী।
বাঙালি- বাঙালির জাতীয় সংগীত, বাংলাদেশের ইতিহাস একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দিগ্দর্শন-এসব কিছু স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছানো যতটা সহজ কোমলমতি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছে দেয়া ততটাই কঠিন। দেশপ্রেম ও জাতীয় সংগীতের অতিজাগরণে জঙ্গিবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তী পর্যায়ে সুনাগরিক হিসেবে সৃষ্টি হতে পারে বাঙালির এক দীপ্ত নতুন পরিচয়। তাই জঙ্গিবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর সীমানায় বাঙালি জাতিসত্তার গৌরব ছড়াবে এমন স্বপ্ন দেখেছেন জিনাত সোহানা। দেশের নানা প্রান্তে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সব ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্য বিলোপের পাশাপাশি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি।
এসব শিক্ষার্থীদের কাছে দেশপ্রেম তৈরির এ আন্দোলনের শুরুটা জিনাত সোহানা করেছেন তার ব্যক্তিজীবন থেকে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক প্রতিরোধে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালিয়েছেন প্রচারণা। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনও বাজেনি জাতীয় সংগীত সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমবেত করে বাজিয়েছেন জাতীয় সংগীত। চট্টগ্রামের বিভিন্ন মাদ্রাসার মাঠে একঝাঁক শিক্ষার্থী। এরা সবাই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। তারা দাঁড়িয়ে পরিবেশন করছে জাতীয় সংগীত। তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে এ সময় কণ্ঠ মেলায় শিক্ষকরাও। একে একে শোনাল দেশের গান, হামদ ও নাত। চট্টগ্রামের মাদ্রাসাগুলোতে এমন বিরল দৃশ্যের পটভূমি রচনা করেছেন জিনাত সোহানা চৌধুরী। সুচিন্তা ফাউন্ডেশন এর হয়ে লড়ছেন জংগিবাদ নির্মূলে। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’এমন সুরে মেতে উঠেছেন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। শপথ বাক্য পড়িয়েছেন জঙ্গিবাদে না জড়ানোর।
চট্টগ্রামের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-যেখানে কখনো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হয়নি, জাতীয় সঙ্গীত যেখানে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে শিক্ষা নেওয়া যারা মেনে নিতে পারেন না, সেই সব কওমি মাদ্রাসায় জয় বাংলা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরি করে বেড়িয়েছেন দুঃসাহসী এই নারী। শুধু কওমি মাদরাসা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মাদরাসায়ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের গল্পগাঁথা নিয়ে নিয়মিত হাজির হতেন তিনি।
পেশায় আইনজীবী হলেও ‘জয় বাংলা স্লোগান’ আর মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরি করে বেড়ানোই হয়ে উঠে তার নেশা। নারীত্বের বাধাকে জয় করে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের শোনান বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের গল্প। তার দীপ্ত পদচারণায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গান আর জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়েছে শত শত মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশের আয়োজন করে এসব সমাবেশে তিনি মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেন তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের গল্পো আলোচনা করেন, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে কথা বলেন।
জিনাত সোহানা পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় গিয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছেন। পৌঁছে দিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সমস্বরে মাদ্রাসা ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে গাইছেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
তিনি দেশের দুর্দিনে নিজেকে বার বার প্রমাণ করেছেন একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে। সামাজিক প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে কাজ করছেন দেশের জন্য। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনদিন বাজেনি জাতীয় সংগীতের সুর, সেখানে তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ঘটিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছেন দৃঢ় কন্ঠে। কওমী মাদ্রাসার কচি কচি প্রাণে সঞ্চার করেছেন সোনার বাংলার গান।
জিনাত সোহানা বলেন, আমি সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের সংগঠকদের সাথে নিয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা করছি চট্টগ্রামের মাদ্রাসাগুলোতে। এর পাশাপাশি ইসলামে দেশপ্রেমের স্থান, গুরুত্ব কোথায়, পড়ুয়াদের শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য মাদ্রাসা বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট দের সাথে নিয়ে চেষ্টা করছি একটি সিলেবাসও তৈরি করতে। যাতে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হবে, তারা যে ধর্ম অনুসরণ করে অর্থাৎ ইসলাম, তাতে দেশপ্রেমকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, দেশকে যারা ভালবাসে, তাদের কতটা মহান করে দেখানো হয়, দেশের প্রতি আনুগত্যকে কতটা বিরাট মূল্য দেওয়া হয়।
জিনাত সোহানা বলেন, মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীদের মাঝে নারী সম্পর্কে এমনিতেই নানা ধারনা প্রচলিত। ইসলামী অনুশাসন অনুসরণ করেই আমি মাদ্রাসাগুলোতে গিয়ে প্রচারণা করেছি। ফলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও আমার প্রচারণাকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। চট্টগ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও দেশপ্রেমের বার্তা পৌঁছাতে আমি কাজ করে যাচ্ছি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একযোগে ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারণায় অংশ নিয়েছে। এটাও মাদ্রাসাগুলোতে আমাদের অতীত প্রচারণার সফলতা বলতে পারেন।
গত মার্চ মাসে করোনার আবির্ভাব হলো বাংলাদেশেও। তখনও অদম্য সাহসী জিনাত সোহানা নিজেকে উপস্থাপন করলেন মানবতাবাদী নারী হিসেবে। দেশের পরিস্থিতি তখন এমন যে করোনা রোগী তো দূরের কথা স্বাভাবিক জ্বর-সর্দির কথা শুনলেই ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছিলো সাধারণ মানুষ। করোনা সন্দেহের জেরে কোথাও কোথাও উপসর্গ থাকা রোগীকে নিষ্ঠুর প্রতিবেশিরা একঘরে করে রাখার মতো অমানবিক আচরণ করেছেন। করোনার এই বিষবাষ্পের ভয়ে নিজের আপনজনের শেষ বিদায় দিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেকের।
এমনই এক কঠিন মূহুর্তে নগরীর হালিশহরে চট্টগ্রাম আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তোলার উদ্দ্যেগ নিলেন এই সময়ের সাহসী নারী জিনাত সোহানা চৌধুরী। করোনা পরিস্থিতির চিকিৎসা সুবিধার চরম সংকটে নিজেকে প্রমাণ করেছেন একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে। করোনা আক্রান্ত হবার ভয়, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ঠেকিয়ে কাজ করেছেন চট্টগ্রামের মানুষের জন্য।
জিনাত সোহানা প্রতিদিন করোনা আইসোলেশন সেন্টারে উপস্থিত থেকে সহকর্মীদের সঙ্গে করোনাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। করোনা আইসোলেশন সেন্টারে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে দেশের দূর্যোগে নিজের দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন । এই আইসোলেশন সেন্টার থেকে সাধারণ রোগীরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ, খাবার থেকে শুরু করে পেতেন সব ধরনের সেবা। তার অদম্য সাহসিকতার গল্প যদিও নতুন কিছু নয়। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন চট্টগ্রামের সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও প্রেরণাকে হৃদয়ে ধারণ করেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন।
বেসরকারি কারা পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কর্মজীবনে আইন পেশাতে ব্যস্ত থাকেন জিনাত সোহানা চৌধুরী। করোনার সংকটময় মুহূর্তে চট্টগ্রামের মানুষের জন্য একটা হাসপাতাল কতটা জরুরী তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি । স্বপ্নবাজ একদল তরুণকে সাথে নিয়ে মাত্র ১০ দিনের প্রচেষ্টায় তারা গড়ে তোলেন ১০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার। যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় পরিপূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্রে। আইসোলেশন সেন্টারটিতে শুরুর দিন থেকে শেষ পর্যন্ত ৭৬২ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত এবং উপসর্গধারীদের সেবা দেওয়া হয়েছে। ১২ জন চিকিৎসক, নয়জন নার্স এবং ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন চিকিৎসা সেবায়।
তিনি দেশকে এগিয়ে নিতে চান, শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়ে। তাই একজন উচ্চ শিক্ষিত নারী হয়েও বিদেশে গিয়ে সুখে থাকার বদলে দেশকেই বেছে নিয়েছেন কাজের ক্ষেত্র হিসেবে। আইন পেশার ব্যস্ততা মাড়িয়ে দেশকে নতুন কিছু দিতে নিজেকে উজাড় করে দিতে চান তিনি।