চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালি কনটেইনারের ভেতর লুকিয়ে জাহাজে বারবার বিদেশ পাড়ি দেওয়ার ঘটনায় বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি।
গত ১৩ বছরে কনটেইনারে ঢুকে ও জাহাজে লুকিয়ে ১০ বার বিদেশে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এদের মধ্যে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৮ জনকে জীবিত ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দুজনকে চট্টগ্রাম বন্দর গেট ও জাহাজ থেকে আটক করা হয়।
২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর বন্দরের ১৩ নম্বর জেটিতে থাকা ‘এমভি মার্কস উইলমিংটন’ জাহাজের কনটেইনারে লুকিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ রিপন। তাকে সেখানে নামানোর অনুমতি না পেয়ে জাহাজটির যাত্রাপথে আফ্রিকার দেশ রি-ইউনিয়নে নামিয়ে দেন নাবিকেরা। এরপর ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি তাকে ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে দেশে ফেরত আনা হয়।
২০১১ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের অস্থায়ী শ্রমিক দ্বীন ইসলাম ও আল আমিন একটি খালি কনটেইনারে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কনটেইনারটি ‘এমভি হ্যানসা ক্যালিডোনিয়া’ জাহাজে তোলার পর সিঙ্গাপুর বন্দরের পাসির পানজাং টার্মিনালে নামানো হয় ৯ এপ্রিল। কনটেইনার খুলে দ্বীন ইসলামকে জীবিত ও আল আমিনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর ২৬ এপ্রিল শ্রীলঙ্কাগামী ‘এমভি টাম্পা বে’ নামের জাহাজে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার সময় বরিশালের আকতার আলী নামের এক ব্যক্তিকে আটক করেন নাবিকেরা। পরে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সোয়েব রিপন নামের এক যুবক সিঙ্গাপুরগামী ‘এমভি হ্যানসা ক্যালিডোনিয়া’ জাহাজে লুকিয়ে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা চালায়। জাহাজের নাবিকরা তাকে ওই জাহাজে করে চট্টগ্রামে ফেরত নিয়ে আসেন। পরে ওই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে বন্দর থানায় হস্তান্তর করা হয়।
২০১৬ সালে চট্টগ্রামের একটি ডিপো থেকে কনটেইনার এনে বন্দর দিয়ে ‘এমভি সিনার বটম’ জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। ১৯ অক্টোবর ভারতের বিশাখাপত্তনম বন্দরে সেই জাহাজের একটি খালি কনটেইনার থেকে রোহান হোসেন নামের মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের বাসিন্দাকে ১২ দিন পর জীবিত উদ্ধার করা হয়।
২০১৭ সালের ৩১ জুলাই যুক্তরাজ্যগামী পোশাকের একটি কনটেইনারের ভেতর থেকে শব্দ শুনে বাবুল ত্রিপুরা নামের শ্রমিককে উদ্ধার করেন চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটি থেকে ১২ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার কেলাং বন্দরে ছেড়ে যাওয়া ‘এমভি ইন্টেগ্রা’ জাহাজের একটি খালি কনটেইনারে আটকা পড়ে কিশোর ফাহিম। ১৬ জানুয়ারি কনটেইনারের ভেতর থেকে শব্দ শুনতে পান নাবিকেরা। ১৭ জানুয়ারি জাহাজটি জেটিতে এনে ২০ ফুট লম্বা কনটেইনার খুলে ওই কিশোরকে উদ্ধার করা হয়।
সর্বশেষ বন্দরে ঢোকার পাস নিয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সিসিটি-২ গেট দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ঢুকেছিল ট্রাকচালক লিটন মোল্যা। রাত সাড়ে ১১টার দিকে জাহাজের পেছনের রেলিং বেয়ে সিঙ্গাপুরগামী এমভি হাইয়ান ভিউ জাহাজে উঠেন। খালি কনটেইনারের ভেতরে ঢুকে সিঙ্গাপুর চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল তার। একপর্যায়ে ক্ষিধে সহ্য করতে না পেরে কনটেইনার থেকে বেরিয়ে আসলে জাহাজের নাবিকদের কাছে ধরা পড়ে। জাহাজটি সিঙ্গাপুর বন্দরে কনটেইনার খালাস করে পুনরায় চট্টগ্রাম বন্দরে ফিরে আসে। এরপর জাহাজের মাস্টার লিটনকে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের হাতে তুলে দেন।
জানা গেছে, খালি কনটেইনার তিন ধাপে যাচাই-বাছাই করার পর জাহাজে তোলা হয়। প্রথমে ডিপো কর্তৃপক্ষ কনটেইনার খুলে দেখার পর দ্বিতীয়বার বন্দরে নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর জাহাজে তোলার আগে কনটেইনারের দরজা খুলে দেখেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টরা। এরপরও যাচাইয়ের কাজে গাফিলতির কারণে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে মানুষ।
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, কনটেইনারের ভেতর লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার ঘটনার দায় বন্দর ও বেসরকারি আইসিডি’র কেউই এড়াতে পারেন না। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতির কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। এতে বিদেশে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, এ পর্যন্ত ৪টি ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। বন্দর থেকে এভাবে ওঠার সুযোগ নেই। ওই ট্রাকচালক বৈধভাবে পাস নিয়ে বন্দরে প্রবেশ করেছিল। এরপর কীভাবে জাহাজে উঠে লুকিয়েছিল, সে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে।