দেশের বিভিন্ন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর হরহামেশা প্রকাশ পায়। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও অনেক সময় জড়িয়ে যান এসব অপরাধে। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিচারের জন্য রয়েছে বিশেষ বিধিমালা। প্রথমে বিভাগীয় মামলা হয়। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে আসে শাস্তির প্রসঙ্গ। বিগত কয়েক বছর প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। ঘটেছে বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনা। অনেকের ক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল বড়। প্রমাণিতও হয়েছে। তবে দেখা গেছে শাস্তি হিসেবে পেয়েছেন লঘুদণ্ড। অনেকের গুরুদণ্ড কমিয়ে দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। এভাবে বারবার লঘুদণ্ড বা শুধু ‘তিরস্কার’ পেয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা।
কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলন, দায়িত্বে অবহেলা, প্রতারণা, দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিতিসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠছে। বিভাগীয় ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, অপরাধ তদন্তে নিয়োগ দেওয়া হয় কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেওয়া হয় শাস্তি। দেখা যাচ্ছে, বড় অপরাধ প্রমাণিত হলেও শাস্তি মোটামুটি বেতন স্কেলের নিম্নতর ধাপে নামিয়ে দেওয়া, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা, তিরস্কার, পদাবনতি- এসব লঘুদণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
অনেক বড় অপরাধ করেও লঘুদণ্ড হয়েছে। শাস্তি বলতে পদোন্নতি দুই বছর বন্ধ থাকা বা বেতন কিছুটা কমিয়ে দেওয়া; এগুলো তো শাস্তি হলো না। অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী।
বিধিমালায় রাখা গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে- নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ ও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা। তবে নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়াকে গুরুদণ্ড মনে করেন না জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। বিধিমালায় অসদাচরণ ও দুর্নীতির জন্য শাস্তি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। যে কোনো শাস্তি দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কর্মকর্তারা জানান, প্রশাসন ব্যাপকভাবে রাজনীতিকীকরণের কারণে অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। দলীয় অনুগত কর্মকর্তারা বড় অপরাধ করলেও লঘু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে প্রশাসনে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হবে না। বরং তা অপরাধ করার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের আরও উৎসাহিত করবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়। অনেক সময় অভিযুক্তের চাকরিকাল, বয়স, মানবিক দিক বিবেচনা করেও শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া যে কারও শাস্তি মওকুফ বা কমিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির।
আলোচিত অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনার ক্ষেত্রে দুদক পদক্ষেপ নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। আর ফৌজদারি অপরাধ সংক্রান্ত কিছু থাকলে সেটায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যখন ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং (বিভাগীয় ব্যবস্থা) শুরু হয়, তখন তার অপরাধটা কী, তা বিভিন্ন শুনানির মাধ্যমে জানার চেষ্টা করি। বিভিন্ন কমিটি স্পটেও যায়। এগুলো থেকে একজন যখন দোষী সাব্যস্ত হয়, তার গ্র্যাভিটি অব ক্রাইম বা ইরেগুলারিটিস যেটা আসে, সেটা অনুযায়ী গুরু বা লঘু শাস্তি দেওয়ার দুটি বিধান আছে—সেটি দেওয়া হয়।
‘রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন সর্বোচ্চ ব্যক্তি, যার অনুমোদন লাগে। রাষ্ট্রপতির শাস্তি মার্জনা বা প্রমার্জনা করার ক্ষমতা আছে। সেই অনুযায়ীও সবদিক বিবেচনা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটি করা হয়। রাষ্ট্র তার কাছ থেকে যদি বেশি অবদান পায়, সেক্ষেত্রে তিনি যে ভুল করেছেন বা কোনো অপরাধ যদি তিনি করেন, তখন সেটি সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এমন কিছু সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, একজন কর্মকর্তা তার ওপর ন্যস্ত রাষ্ট্রের সেবামূলক দায়িত্ব পালন করেন। একটা জায়গায় হয়তো কোনোভাবে ভুল করে ফেলেন। সেই ভুলটা কেমন হয়েছে, সেটার ওপর ভিত্তি করে অনেক সময় রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেন।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, বিষয়টি আমিও লক্ষ্য করেছি। অনেক বড় অপরাধ করেও লঘুদণ্ড হয়েছে। শাস্তি বলতে পদোন্নতি দুই বছর বন্ধ থাকা বা বেতন কিছুটা কমিয়ে দেওয়া; এগুলো তো শাস্তি হলো না।
অনেক বড় অপরাধ করেও লঘুদণ্ড হয়েছে। শাস্তি বলতে পদোন্নতি দুই বছর বন্ধ থাকা বা বেতন কিছুটা কমিয়ে দেওয়া; এগুলো তো শাস্তি হলো না। সাবেক মহা-হিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) হাফিজ উদ্দিন আরও বলেন, আমাদের দেশে তো অপরাধের সঠিক শাস্তি হয় না বলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি না হওয়াটা একটা বড় সমস্যা। প্রশাসন তো এখন অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে রাজনীতিকীকরণ। প্রশাসনে রাজনীতিকীকরণের কারণে দুর্নীতি আরও বেড়ে গেছে। শাস্তিও তো সেভাবে হয় না। কোনো শাস্তির প্রস্তাব এলে তদবির আসে- তাই সামান্য শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাইরে থেকে আমরা এটাই দেখছি।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, যখন কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তখন একটি প্রাথমিক তদন্ত হয়। যখন প্রাথমিক তদন্তে বোঝা যায় অভিযোগের কিছুটা হলেও সত্যতা আছে, তখন সার্ভিস রুলস অনুযায়ী তদন্ত করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে থাকে তিনি কোনো অপরাধ করেছেন কি না? সেই অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনায় যে শাস্তি আসবে, সেটাই মূলত শাস্তি।
‘অনেক সময় শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর নির্ভর করে। যিনি শাস্তি দেবেন তার বিবেচনার ওপরও এটি নির্ভর করে।’ তিনি বলেন, কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসির বিরুদ্ধে যা যা শুনেছি সে অনুযায়ী তার বড় কোনো শাস্তি হলেই সাধারণ মানুষ হিসেবে খুশি হতাম। তদন্ত কর্মকর্তা বা যিনি বিচারের দায়িত্বে আছেন তার তো খুশি বা বেজার হওয়ার বিষয় নেই।
আবু আলম আরও বলেন, আমাদের তদন্ত কিংবা আইনে কোনো দুর্বলতা আছে। আবার আমরা যে মিডিয়া ট্রায়াল করছি সেটা সঠিক নাও হতে পারে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, বিভাগীয় মামলায় দণ্ড দেওয়া হয় অভিযোগের মাত্রা বিবেচনায়। অনেক সময় শাস্তির মাত্রা নির্ভর করে তিনি কত কাছের লোক, কত দূরের লোক সেটার ওপর। অনেক সময় দেখা যায়, যার লঘুদণ্ড হওয়ার কথা তাকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়, আবার যাকে গুরুদণ্ড দেওয়ার কথা তাকে লঘুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। যিনি দণ্ড দেবেন তিনি বিচক্ষণতা ও ন্যায়নিষ্ঠার পরিচয় দিলে তো এটা হওয়ার কথা নয়।
সরকারি চাকরিজীবীদের অপরাধের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালাও বাধা মন্তব্য করে ফিরোজ মিয়া বলেন, এই বিধিমালায় দুর্নীতিগ্রস্তদের লঘুদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আগের বিধিমালা অনুযায়ী, দুর্নীতি প্রমাণ হলে কাউকে আর চাকরিতে রাখার সুযোগ ছিল না। আইন-কানুন যদি এভাবে থাকে তবে বিভাগীয় মামলায় শাস্তিও তো সেই অনুযায়ী হবে।
বিভাগীয় পদক্ষেপ হিসেবে অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধের তুলনায় নগণ্য বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, বদলি করা হয়, তিরস্কার করা হয়, পদোন্নতি আটকানো হয়- এগুলো প্রমাণিত অভিযোগের তুলনায় নগণ্য।