বন মামলায় দুই জন আসামির ৬ মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ এবং ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। অর্থ অনাদায়ে আরো ৩ মাস সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত।
আসামিরা হলেন, টেকনাফ উপজেলার বাহারছরা ইউনিয়নের উত্তর শীলখালী এলাকার সৈয়দ সুলতানের ছেল ছৈয়দুল ইসলাম এবং একই এলাকার ছালেহ আহামদের ছেল মোহাম্মদ উল্লাহ প্রকাশ মাদু।
কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নম্বর-৫ এর বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) রায় প্রদান করেন।
এ সময় বন বিভাগের পক্ষে ছিলেন এফিসিসও আনোয়ারুল ইসলাম। আসামি পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
কিন্তু এই সাজার পরিবর্তে মামলার প্রকৃতি, আসামিদের পূর্বাপর অপরাধ সংঘটন, বয়স ও লঘু অপরাধ বিবেচনায় শুধুমাত্র ক্ষতিপূরনের অর্থ পরিশোধ, দুঃস্থদের খাওয়ানো, গঠনমূলক কর্ম সম্পাদন ও ভাল আচরণ করার জন্য আসামিদের প্রবেশন সাজা অর্থাৎ বিকল্প সাজার আদেশ দেন বিচারক। এতেকরে আসামিরা তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে সংশোধনের সুযোগ পাবে মনে করেন আদালত।
দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও ‘প্রত্যাহিক সেবামূলক কর্ম’ সম্পাদনের শর্তে সাজা মওকুফ করেছেন বিচারক। এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক রায়।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন বন আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শফি।
মামলার তথ্য বিবরণির সুত্র ধরে তিনি জানান, ২০১৭ সালের ২৯ জুন সকাল ৯ টার দিকে টেকনাফ উপজেলার বাহারছরা ইউনিয়নের শীলখালী রেঞ্জের শীলখালী বন বিটের আওতাধীন উত্তর হ্নীলা মৌজার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বনভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মনো চারা ও জঙ্গল কেটে জবর দখলের অপচেষ্টা করছিলেন ২ ব্যক্তি। বন বিভাগের টহল টিম খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে জবর দখলকারীদের ধৃত করার চেষ্টা করলে তারা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে চারা ও মাটি কাটার সরঞ্জাম উদ্ধার পূর্বক জব্দ করে বন বিভাগের টহল টিম।
এ ঘটনায় বন বিভাগ ২ জনকে আসামি করে ১৯২৭ সনের বন আইনের (২০০০ সালে সংশোধিত) ২৬ (১ক) ধারায় অভিযোগ এনে আদালতে মামলা দায়ের করেন। যার বন মামলা নম্বর ৩৮/২০১৭ (টেকনাফ)।
২০২২ সালের ৩ মার্চ মামলাটি বিচারের জন্য কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নম্বর-৫ এ চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়।
বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ মামলাটির ১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। আসামিদ্বয় আদালতে তাদের অপরাধ স্বেচ্ছায় স্বীকার করেন। মামলার অন্যান্য সকল বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ১৯২৭ সনের বন আইনের (২০০০ সালে সংশোধিত) ২৬ (১ক) ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিজ্ঞ বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ মামলার ২ জন আসামির প্রত্যেককে ৬ মাস করে সশ্রম কারাদন্ড, ১০ হাজার টাকা করে সরকারকে ক্ষতিপূরণ এবং ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরো ৩ মাস সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেন।
রায়ে বিজ্ঞ বিচারকের দেওয়া প্রবেশন আদেশের শর্তসমূহ হচ্ছে :
(১) রায় ঘোষণার তারিখ হতে পরবর্তী এক বছরের জন্য প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার ও বুধবার আসামীরা সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত ‘প্রত্যাহিক সেবামূলক কর্ম’ সম্পাদন করবেন। রায়ে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ চালানের মাধ্যমে জমা করে আদালতে চালানের কপি দাখিল করতে হবে। আসামিরা কোন অপরাধকর্মে জড়িত হবেন না। অনুরূপ অপরাধ আর করবেন না মর্মে ৩ কপি বন্ড সম্পাদন করে, বন্ডের এক কপি সংশ্লিষ্ট থানায়, এক কপি বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এবং এক কপি মামলার নথিতে দাখিল করতে হবে।
(২) আসামীদের বয়স, কর্মক্ষমতা ও প্রচলিত আইন বিবেচনায় আদালতের রায় অনুযায়ী শীলখালী রেঞ্জ কর্মকর্তার আওতাধীন শীলখালী বন বিট কর্মকর্তা তাদের জন্য কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করে তাঁর এলাকায় একজন ভিলেজার/শ্রমিক যেভাবে কাজ করেন, সেভাবে আসামিদের দিয়ে প্রত্যাহিক সেবামূলক কর্ম সম্পাদন করিয়ে নেবেন।
(৩) আসামীদ্বয় কক্সবাজার পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোনারপাড়ায় অবস্থিত সার্বজনীন শ্রী শ্রী কৃষ্ণানন্দধাম মন্দিরে যৌথভাবে ১০০ জন দুঃস্থকে এক বেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবেন। মন্দিরে দুঃস্থদের খাওয়ানোর পর প্রবেশন কর্মকর্তা এ বিষয়ে আগামী ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দেবেন।
(৪) আসামীরা সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন এবং ভাল আচরণ ও ভাল ব্যবহার করবেন।
(৫) বিচারক/আদালত, আইনশৃংখলা বাহিনী কর্তৃক তলব করা হলে তদানুসারে উপস্থিত হতে আসামীরা বাধ্য থাকবেন।
(৬) আসামীরা কোন প্রকার মাদকদ্রব্য/নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করবেন না।
(৭) টেকনাফের প্রবেশন কর্মকর্তা আসামীদ্বয়ের নিয়মিতভাবে প্রবেশন তত্বাবধান ও পর্যবেক্ষন করবেন। প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর ধার্য তারিখে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
(৮) আসামীরা কোন শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে, শর্ত ভঙ্গ করলে বা আসামিদের আচরণ সন্তোষজনক না হলে প্রবেশন বাতিল বলে গণ্য হবে। অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আবার আসামিরা প্রবেশনকালীন সময়ে সন্তোষজনকভাবে শর্ত পালন করলে এই দন্ড ভবিষ্যতে জীবনের কোন পর্যায়ে আসামির অযোগ্যতা বলে গণ্য হবেনা।
(৯) কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন আহমদ আসামিদের রায়ের মর্ম বুঝিয়ে দেবেন। প্রবেশন কর্মকর্তার কাছে ৪ সেপ্টেম্বর আসামিদের হাজির করবেন।
প্রবেশনের বিষয় অবহিত করার জন্য বিজ্ঞ বিচারকের আদেশের কপি কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও, মাজসেবা উপপরিচালক, টেকনাফের শীলখালীর রেঞ্জ অফিসার এবং প্রবেশন কার্যকর করার জন্য আদেশের কপি কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, টেকনাফ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা, টেকনাফ থানার ওসি এবং সার্বজনীন শ্রী শ্রী কৃষ্ণানন্দধাম মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।