বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং রামুর উপজেলার পূর্ব-উত্তরে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য। দুই উপজেলার অন্তত দুইশ কিলোমিটার সীমানা পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার। এই সীমানা এলাকায় বড় কোন নদী নেই। পাহাড়ী আকাঁবাকা পথ পাড়ি দিয়ে হেঁটেই পার হওয়া যায় মিয়ানমারের ওপারে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গত দুই মাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি এবং রামু উপজেলার বিভিন্ন চোরাই পথে দিয়ে মিয়ানমারের গবাদী পশুর রমরমা বাণিজ্য চলে আসছে। দুই উপজেলার জামছড়ি ফুলতলী,আশারতলী চাকঢালা,কম্বনিয়,জারুলিয়াছড়ি তুমব্রুসহ বেশ কিছু চোরাকারবারি স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিয়ে এই অবৈধ বাণিজ্য করে আসছে। এতে করে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব যেমন হারাচ্ছে, ঠিক তেমনি মাদক বিস্তারের সুযোগও তৈরী করেছে এই চক্রটি। কিন্তু গত আগস্ট মাস ধরে মিয়ানমার সীমান্তে সেদেশের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় থাকার পরও মিয়ানমারে ওপার থেকে কিভাবে অবাধে গরু আসছে সেই প্রশ্ন তোলেছেন সচেতন নাগরিক সমাজ। গত এক মাসে দুই উপজেলার সীমান্ত এলাকা ঘুরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোথাও মিয়ানমারের বিজিপি,আবার কোথাও আরাকান আর্মি, এবং আরসার সদস্যদের সঙ্গে আতাঁত করার কারনেই বিনা বাঁধায় মিয়ানমারের গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এই ক্ষেত্রে চোরাকারবারী চক্রটি ওপারে বাংলাদেশ ভুখন্ডের তথ্য পাচার করছে কিনা সেই প্রশ্নও উঠেছে। অবৈধ পথে নাইক্ষ্যংছড়ি ও রামুর কচ্ছপিয়া বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবাধে মায়ানমারের গরু মহিষ বাংলাদেশে ঢুকছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত বান্দরবান ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাংস বিক্রির জন্যই সারাবছর বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মায়ানমার থেকে অবৈধ পথে গরু আনা হয়। এসব গরুর বেশিরভাগই স্টেরয়েড দিয়ে মোটাতাজা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মায়ানমার থেকে আসা গরু মাংসের দোকানগুলোতে কোনো রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই জবাই করে বিক্রি করা হয়। এসব গরুর মাংসের মাধ্যমে জনসাধারণ নানান জটিল রোগে আক্রান্তের আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি ও রামু উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী জামছড়ি ও ফুলতলী এবং জারুলিয়াছড়ি এলাকা দিয়ে গত এক মাসে অধিক সময় ধরে অবৈধ গরুর ব্যবসা চলে আসছে। এই সময়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ১১ বিজিবি কয়েক মাসে প্রায় ১কেটি টাকার ৭৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা মহিষ গরু জব্দ করে এবং ককসবাজার জেলার ৩৪ বিজিবি এবং নাইক্ষ্যংছড়ি ও রামু থানা'র পুলিশ একাধিক অভিযান করে অসংখ্য অবৈধ গরু আটক করতে সক্ষম হয়। গত কয়েকমাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি ও পুলিশ চোরাই গরু আটকে তৎপর হলে চোরাকারবারিরা পথ পাল্টিয়ে রামুর কচ্ছপিয়া ও গর্জনিয়ার ফাক্রিকাটা,ক্যাজর বিল নাইক্ষ্যংছড়ি বাইশারী, ঈদগড়, কাগজিখোলা পথ ব্যবহার করে আসছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দায়িত্ব পালন করে গরু চালান এলাকার বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন চোরাকারবারিরা। এক্ষেত্রে কেউ পুজি, কেউ ক্ষমতা বিনোয়াগ করে থাকে। আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রধানদের প্রত্যেক গরুর জন্য ১৫০০থেকে ২০০০ টাকা করে সিন্ডিকেট প্রধানরা আদায় করে থাকে। যে টাকা নেওয়া হয় বিভিন্ন খাতে ‘ম্যানেজ’ করার নামে। দুই উপজেলার সচেতন নাগরিকদের মতে, মিয়ানমারের চোরাই গরুর কারণে দেশীয় গরু খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি গরু ব্যবসার আড়ালে মাদকের বিস্তারও বেড়ে যাচ্ছে। চোরাকারবারিরা মিয়ানমারের ওপারের ব্যবসায়ী ও বিজিপির সঙ্গে সম্পর্ক না-রাখলে সীমান্তের এমন পরিস্থিতিতে গরু আনা সম্ভব নয়। তাই এসব চোরাকারবারি দ্বারা রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। এই ব্যাপারে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শফিউল্লাহ জানান, যারা নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে গরু বাংলাদেশে আনছে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিবে। এসব অবৈধ গরু ব্যবসায়ীদের ধরতে উপজেলা প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সবসময় সহযোগিতা করবে। নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির অধিনায়ক লে: কর্নেল মো: রেজাউল করিম জানান, সীমান্ত পথে গরু চোরাচালান রোধকল্পে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি কর্তৃক কঠোর নজরদারী ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও যেকোন মূল্যে নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন (১১ বিজিবি) চোরাচালান প্রতিরোধে বদ্ধ পরিকর এবং ভবিষ্যতে মাদক ও চোরাচালান দমনে নিয়োজিত থেকে যেকোন আন্তঃ রাষ্ট্রীয় অপরাধ দমনে বিজিবি কঠোর অবস্থানে আছে এবং সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধ বার্মিজ গরু, মাদকদ্রব্য পাচার, অস্ত্র, অবৈধ কাঠ পাচার/পরিবহন, অন্যান্য যে কোন ধরনের অবৈধ পণ্য সামগ্রী পাচার এবং অত্র এলাকায় যেকোন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে বিজিবি’র তৎপরতা অব্যাহত আছে। তিনি আরও জানান, যে সকল ব্যক্তিবর্গ চোরাচালানী কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত এবং সে যেই হোক চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।