রমজান মাস আসার আগেই জাল নোটের কারবারিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চলতি মাসেই পুলিশের অভিযানে ধরা পড়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা জাল নোট। গত তিন বছর করোনার সংক্রমণের কারণে ঈদ বাজারে টাকার ছড়াছড়ি কম ছিল। তাই তারা তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত ১ মার্চ লোহাগাড়ার চুনতি রেঞ্জ বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে থেকে চট্টগ্রামগামী যাত্রীবাহী হানিফ বাস থেকে ২০ লাখ টাকার জাল নোটসহ ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে, তারা আসন্ন রমজান ও ঈদ ঘিরে বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন টাকা বাজারে এলেই জাল নোটের কারবারিদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। তারা বিভিন্নভাবে বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেও সক্রিয় থাকে জাল নোটের কারবারিরা। এর কারণ, বিভিন্ন সময় ধরা পড়লেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনের ফাঁকফোকরে বেরিয়ে যায় তারা।
বছরজুড়েই জাল নোট তৈরির কারবারিরা সক্রিয় থাকলেও রমজান, ঈদ ও কোরবানির পশুর হাটসহ বড় বড় অনুষ্ঠান ঘিরে বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। ঢাকার পর চট্টগ্রামে জাল টাকার কারবারিরা বেশি সক্রিয়। তারা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে আস্তানা গেড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি দুই হাজারের বেশি জাল টাকার কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত সাড়ে ৪০০ আছেন বিদেশি। তাদের অধিকাংশই আফ্রিকান।
আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(ক) উপধারায় জাল নোট কারবারের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল। তবে ১৯৮৭ সালে এরশাদ শাসনামলে সে বিধান রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়।
জাল নোট নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে করতে একটি আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধ সংক্রান্ত কমিটির সভায় ৬ সদস্যের একটি উপকমিটি করা হয়। এ উপকমিটি আইনের খসড়া প্রণয়ন ও চূড়ান্ত করে এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে। এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত অগ্রগতি জানা যায়নি। তবে নতুন আইনটি পাস হলে এটি হবে দেশে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে প্রথম আইন। জাল টাকার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়টি শাখার চার কর্মকর্তাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাল নোট চক্রের সদস্যরা রমজানের আগেই তৎপরতা শুরু করলেও তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোনও বড় উৎসবের আগে তাদের তৎপরতা বাড়ে। এ সময়গুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানও বেশি হয়। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা নোট তৈরির নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করছে। অ্যাপ ব্যবহার করে নোট তৈরি করছে কেউ কেউ। বড় নোটের বিষয়ে মানুষ সতর্ক থাকে, তাই তাদের ছোট নোট তৈরিতে আগ্রহ বাড়ছে।
জাল নোট তৈরি ও বিক্রি একটি লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় কারখানায় ৫০০ ও ১০০০ টাকার জাল নোট তৈরি করতে যে খরচ হয় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লাভে সেগুলো এজেন্টদের কাছে বিক্রি করে কারখানার মালিক। খুচরা বিক্রেতারা সুযোগ বুঝে কাপড়ের বাজার থেকে শুরু করে মাছ বাজার, মাংস বাজার, পশুর হাট, সবজি বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে কৌশলে এক-দুইটি করে নোট টাকার বান্ডিলে ঢুকিয়ে ছেড়ে দেয়। এভাবে জাল নোট ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা (বন্দর ও পশ্চিম ) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, সাধারণত রমজান ও ঈদ এলে জাল নোট কারবারিরা সক্রিয় হয়। আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। জাল নোট চক্রের কোনও তথ্য পেলেই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
লোহাগাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিকুর রহমান বলেন, গত ১ মার্চ চট্টগ্রামগামী যাত্রীবাহী হানিফ বাসে তল্লাশি চালিয়ে মো.রুবেল ও ওমর আলী নামে দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের হেফাজত থেকে ১ হাজার টাকার নোট ১ লাখ টাকা করে ২০টি বান্ডেলে মোট ২০ লাখ জাল টাকা উদ্ধার করা হয়। পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে প্রতারক চক্রটি সবজির বাজারের ব্যাগে ভর্তি করে সবজির নিচে জাল নোটগুলো লুকিয়ে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম শহরে বিনিময় করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, কক্সবাজারে অবস্থানকারী তাদের একজন সহযোগী জাল নোটগুলো বিনিময়ের জন্য সরবরাহ করেছিল।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের মিডিয়া মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন বলেন, আসন্ন রমজান ও ঈদ সামনে রেখে কিছু জাল টাকার কারবারি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ২০ লাখ টাকাসহ দুইজনকে গ্রেফতার হয়েছে। রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে যাতে জাল নোট ছড়িয়ে দিতে না পারে পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ’র নির্দেশনায় থানা পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। নিয়মিত চেকপোস্ট এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে অভিযান পরিচালনা করছে। এছাড়াও যারা ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে আছে তারা জামিনে বের হয়ে কি করছে সেদিকে নজরদারি করা হচ্ছে। জাল নোট কারবারিদের ধরতে জেলা পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।