বাংলাদেশের ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি খেলার নানান ইতিহাসের সাক্ষী বুলু চন্দ্র ঘোষ। তিনি স্টেডিয়াম পাড়ায় ‘বুলু ভাই’ নামেই বেশি পরিচিত। পারিশ্রমিক যা-ই হোক, ৩২ বছর ধরে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁর সংসার।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ও ম্যাচের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বেশি সময় থাকা হয় ক্রিকেট মাঠে। ৯০ দশকে ফুটবল মাঠে আবাহনী ও মোহামেডানের খেলা নিয়ে মারামারি দেখেছেন, ক্রিকেট খেলা দেখতে এসে গ্যালারিতে দর্শকদের সংঘাত দেখেছেন, দেখেছেন হকি খেলোয়াড়দের হকিস্টিক নিয়ে মারামারিও। তিনি পেশায় টি বয়। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে কথা হয় বুলু ভাইয়ের সঙ্গে ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিশ্বকাপ আসরে খেলতে আসা প্রত্যেক খেলোয়াড়কে চা খাওয়ানোর সুযোগ হয়েছে। দেশের প্রায় সব খেলোয়াড়কে নিজ হাতে চা বানিয়ে খাইয়েছি। ফুটবলে সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় লিওনেল মেসি বা ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকে চা খাওয়ানোর ছবি আছে আমার সংগ্রহে। শুধু ধোনি নন, সুরেশ রায়না থেকে রবি শাস্ত্রী, ওয়াকার ইউনুস, শহীদ আফ্রিদি- সবাই আমার হাতে তৈরি চা পছন্দ করেন। বিদেশিদের মধ্যে লিওনেল মেসি, ক্রিস গেইল, কুমার সাঙ্গাকারা, শহীদ আফ্রিদি- সবাইকেই চায়ের নেশা ধরিয়ে দিয়েছি।
তবে বিদেশিদের মধ্যে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে খুব পছন্দ করেন বুলু। তিনি বলেন, আমি এই মানুষটার ভক্ত। তাঁকে চা খাওয়াতে পেরে আমি ধন্য। দেশে আমার পছন্দের খেলোয়াড় তামিম ইকবাল, আরেকজন মুশফিকুর রহমান।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন স্টেডিয়ামে আসেন, তখন গেইটে দায়িত্ব পালন করেছি। তাঁর সঙ্গে আমার ও মেয়ের ছবি তুলেছি। আমার দুই মেয়ে। বড় মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে চাই। ছোট মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে’ বলেন বুলু।
মাঠে খেলোয়াড়রা নামার সময় চা নিয়ে তৈরি থাকতেন জানিয়ে বুলু বলেন, মাঠে নামার সময় খেলোয়াড়দের চা খাওয়ানো হতো। তামিম ইকবাল পছন্দ করতেন লিকারের মধ্যে আদা, চিনি ও লেবু। মুশফিক পছন্দ করতেন আদা ও লেবুর চা। মাশরাফি ভাই বলতেন- চিনি দিবি না, চিনি ছাড়া আদা দিয়ে চা বানিয়ে দিবি। আদা দিয়ে এমন চা বানিয়ে দিলাম, তিনি চা পান করে আর ফেলে দেন না। ধোনি ভাই বলেছেন, আদা বেশি কেন? আরও কম। আদা কম, লেবু বেশি। দুই তিন বছর পরীক্ষা করেছি, আমার চা খেয়ে কোনও খেলোয়াড় এখন ‘না’ বলবে না।
দেশের খেলোয়াড়রা নানান সময় বুলুকে টাকা উপহার দিতেন। খালেদ মাহমুদ সুজন, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, রিয়াদ ভাই দিয়েছেন বকশিস। একবার তামিমকে চা খাওয়ানোর সময় আড্ডা দিচ্ছিলেন বুলু। কথার একপর্যায়ে তামিম বললেন, ‘যদি সেঞ্চুরি করতে পারি, তোকে এক লাখ টাকা দিবো’। আমি কথাটা শুনিনি। আমার সঙ্গে সোহেল নামে এক ছেলে ছিল। সে এ কথা শুনেছিল। মাঠে খেলতে গিয়ে তামিমের সেঞ্চুরি হয়ে যায়। তখন সোহেল চিৎকার করে বললো- বুলু ভাই আপনি এক লাখ টাকা পাচ্ছেন। তামিম ভাই সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। এ কথা শুনে খেলা শেষে আমি তামিম ভাইকে ধরলাম। তিনি হোটেলে গিয়ে এক লাখ টাকার চেক লিখে দিলেন। সাত বছর আগের এক লাখ টাকা ব্যাংকে এখন দুই লাখ টাকা হয়েছে। এই টাকা দিয়ে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ইচ্ছে আছে।
এই পেশায় কিভাবে এলেন এমন প্রশ্নের জবাবে বুলু বলেন, ১৯৯০ সালে ফুটবল মাঠের মূল গেইটে দায়িত্ব পালন করতাম। বাকি সব গেইট বন্ধ করে রাখা হতো। কোনও কর্মকর্তাকে মাঠে প্রবেশ করতে দেইনি। কাজ করতে গিয়ে, মারামারির মধ্যে পড়ে অনেকবার মাথায় আঘাত পেয়েছি। তখন ৬ মাস ফুটবল মাঠে আর ৬ মাস ক্রিকেট মাঠে কাজ করতাম। ক্রিকেট বোর্ড থেকে কাজ করার প্রস্তাব এলে তা লুফে নেই। বিসিবি’র সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করি। ক্রিকেট মাঠে কাজ শুরু করলে দেখলাম, ক্রিকেট ম্যাচ দেখতেও মানুষ আসে। কখনও সাংবাদিক গেইট, কখনও ভিআইপি গেইট, কখনও টিকিটের গেইটে ডিউটি করেছি। কাজ করতে করতে খেলোয়াড়ের সঙ্গে মিলে গেলাম। আমার বাসা ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পাশে। করোনার জন্য এখন খেলোয়াড়দের সঙ্গে থাকা যায় না। এই পেশায় টাকাও নেই। ছেড়ে দিবো ভাবি কিন্তু মায়ার টানে ছেড়ে যাওয়া হয় না আর।