আজ রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্তৃক সংবর্ধিত মিরসরাইয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন

নিজস্ব প্রতিবেদক, মিরসরাই : | প্রকাশের সময় : শনিবার ৬ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫২:০০ পূর্বাহ্ন | উত্তর চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংবর্ধিত হয়েছেন মিরসরাইয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন। গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের আয়োজনে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে নগরীর সার্কিট হাউজে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা প্রদান ও ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম জেলার ২০৩ জন ও মহানগরীর ১৩৫ জনসহ মোট ৩৩৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ক্রেস্ট, প্রাইজবন্ড ও উপহার সামগ্রী দিয়ে এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার রাজীব হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা ও ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার মোঃ তোফায়েল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ মাহফুজুর রহমান, জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ্, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ ও জেলা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম সরোয়ার কামাল।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন বলেন, ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানিদের হামলার পর প্রথম ভাগেই মিরসরাইতে সংগঠিত হতে থাকে মুক্তিপাগল জনতা। এপ্রিলের প্রথম দিকে উপজেলার মিঠাছরা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হয় ছাত্রজনতাসহ কয়েকশ’ যুবক কিশোর। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। এলাকার যুবকদের অনেককে স্কুল মাঠ থেকে বড় একটি ট্রাকে উঠতে দেখে আমিও সে ট্রাকে উঠে পড়ি। তখনও আমি জানতাম না তিনি কোথায় যাচ্ছেন বা তার গন্তব্য কোথায়? কিন্তু শেষে করেরহাট-কয়লা হয়ে যখন ট্রাকটি থামে রামগড়ে তখন তিনি জানতে পারলেন এলাকার বড়জনেরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে যেতে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছেন। তখন তাঁর মনেও একধরণের সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত হতে শুরু করলো। তাদের সঙ্গে তিনিও পাড়ি জমালেন ভারতে। মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন মিলে সংসারে ১১ জন সদস্য ছিলেন। পরিবারের ছেলেদের মধ্যে তিনি মেজ। বয়স তখন তাঁর মাত্র ১৫ বছর। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি রামগড় হয়ে ভারতে যান। সেখানে সীমান্ত পাশ^বর্তী ভারতীয় এলাকায় একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে ১৫ দিন গেরিলা ট্রেনিং নেন। এরপর দেশে ফিরলে প্রথমে শুভপুর ব্রিজ পাহারার দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। তাঁর সঙ্গে আরো ২০-২৫ জন কিশোর-যুবক মুক্তিযোদ্ধা বাংকার খুঁড়ে সেখানে ব্রিজ পাহারার দায়িত্ব নেন।

মিরসরাইয়ের শুভপুর ব্রিজ যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মোক্তার হোসেন বলেন, ‘বাংকার থেকে কয়েদিন টানা পাহারা দিলাম। হঠাৎ একদিন পাকিস্তানী আর্মিরা বিমান থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। সেদিন আমার বয়সী বেশ কয়েকজন যোদ্ধা আমার চোখের সামনেই শহীদ হন। আমি ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। কারণ সেখানে আমার পাশের গ্রামের কয়েকজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ঘটনার পরক্ষণে নিজের কাছে থাকা রাইফেল ফেলে বাড়ি চলে আসি।’

তিনি আরো বলেন, ‘কয়েকদিন পর আবার যুদ্ধে যাবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলাম এবং তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কেফায়েত মিয়া চেয়ারম্যানের সাথে আবার ট্রেনিং নিতে ভারতে গেলাম। সেখানে একমাস ট্রেনিং নেয়ার পর ফিরে এসে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবুল হোসেনের সাথে ফটিকছড়িতে কয়েকদিন থাকলাম। পরে মিরসরাইয়ের মিঠানালা ইউনিয়নে কমান্ডার আলী আজমের নেতৃত্বে বেশ কিছু সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিই। ওইসময় আবুতোরাব বাপনাপুকুর পাড় এলাকায় পাকিস্তানিদের সাথে মুখোমুখি একটি যুদ্ধে আমার ডানহাতের আঙ্গুলে গুলি লাগে। অবশ্য এটি ছিল মিরসরাইতে পাকিস্তানিদের শেষ দিন। ওইদিন ছিল ৭ ডিসেম্বর। পরদিন ৮ ডিসেম্বর সকাল থেকে পাকিস্তানীরা পিছু হটতে শুরু করে। ৯ ডিসেম্বর মিরসরাই হানাদার মুক্ত হওয়ার পর আমাকে আমার সহযোদ্ধারা মাস্তাননগর হাসপাতালে ভর্তি করায় এবং আমি ১০ দিনে সুস্থ হয়ে উঠি।’

কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেনের বাবা মরহুম আমির হোসেন ছিলেন একজন কৃষক। মা মরহুমা আনোয়ারা বেগম নানা কষ্টে তাঁর ছয় ছেলে সন্তান এবং তিন কন্যা সন্তানকে মানুষ করেন। নানা অর্থকষ্টে কেটেছে মোক্তার হোসেনের পারিবারিক জীবন। ১৯৮৯ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন তিন ছেলে সন্তানের বাবা। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর বাড়ি উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের পূর্ব দুর্গাপুর গ্রামে থাকলেও বর্তমানে তিনি একই ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নিজের বাড়িতে বসবাস করছেন। সংসার এবং জীবনযাপন সম্পর্কে মোক্তার হোসেন বলেন, ‘১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রথম ৩০০ টাকা ভাতা দেন। বর্তমানে আমি ১২ হাজার টাকা ভাতা পাই। তবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাইনা।’ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেনের মন্ত্রণালয় সনদ নম্বর ১৩৭৮৮৫, মুক্তিবার্তা (লালবই) নম্বর ০২০৩০৪০২১১, গেজেট নম্বর ৪৮৩৯।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিভাগীয় কমিশনার মোঃ তোফায়েল ইসলাম বলেন, আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে মুক্তিযোদ্ধারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শুধুমাত্র দেশপ্রেমের বলে মুক্তিযোদ্ধারা নিজের অস্তিত্বকে বিলিয়ে দিয়ে অস্ত্রে ও প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ পাক বাহিনীকে হারিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় নিজের জীবন। কিন্তু আপনারা নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবেসেছিলেন দেশকে ও জাতিকে। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না, হবার নয়।